কলকাতা: এমনিতেই নিত্যদিনের রোগ ব্যাধি লেগেই আছে তার উপর সাধারণভাবে খিদে বাড়ানোর ওষুধ, এরপর খাবার খাওয়া হলে তা হজমের জন্য ওষুধ, ঘুমের ওষুধ, রোগা হওয়ার ওষুধ, মোটা হওয়ার ওষুধ। অর্থাৎ সারাদিন কোনো ওষুধ না খেয়ে আছেন, এযুগে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
কিন্তু একটানা ওষুধ খেয়ে শরীরে জমছে ‘বিষ’। ফলে কার্যত কোনো ওষুধেই আর কাজ হচ্ছে না এমন প্রমাণ মিলেছে বহু ক্ষেত্রে। এমন বহু রোগ আছে, যার জন্য সারাজীবন ধরে ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে মারাত্মক এবং দীর্ঘস্থায়ী। এই ধরণের ওষুধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে কিডনি, লিভার। তবে এবার এবিষয়ে সমাধান সূত্র খুঁজে পেয়েছেন যাদবপুরের বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের গবেষকরা। শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় ওষুধের জমে থাকা বিষ বা ‘পলি’-কে বের করে দিয়ে কাটিয়ে ওঠা যাবে সেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। একেবারে ড্রেজিংয়ের কায়দায় তুলে ফেলা যাবে এই 'পলি' এমনটাই দাবি করেছেন গবেষকরা
সাইক্লোডেক্সট্রিন নামে একটি রাসায়নিক আছে যা বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে শরীরের নির্দিষ্ট জায়গায় ওষুধটিকে পৌঁছে দিতে ব্যবহার করা হয় । এর মাধ্যমে একেবারে সেই সঠিক কোষে পৌঁছে যাবে ওষুধটি যেখানে তার কার্যকারিতা। বিভিন্ন ধরনের ওষুধেই সাইক্লোডেক্সট্রিন-এর ‘কোটিং’ থাকে। আর সাইক্লোডেক্সট্রিনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে শরীরকে ওষুধমুক্ত করার ক্ষমতা। এর তাত্ত্বিক প্রমাণও মিলেছে বলে দাবি করেছেন যাদবপুরের অধ্যাপক নীতিন চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর সহযোগীরা। তিনি জানিয়েছেন, গবেষণায় দেখা গেছে, সাইক্লোডেক্সট্রিন নামে এই রাসায়নিকটি সহজেই জলে গুলে যায়। ফলে ওষুধের বর্জ্য মূত্র বা ঘামের সঙ্গে বেরিয়ে যেতে পারে।
এই গবেষণার কাজে ব্যাবহার করা হয়েছে একটি বিশেষ প্রাণী যা চাইনিজ হ্যামস্টার নামে জনপ্রিয়। ছোট্ট এই পোষ্যটি বিশ্বের কম-বেশি প্রায় সমস্ত গবেষণাগারেই কাজে লাগানো হয়। এই প্রাণীটির ওপরেই পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালিয়ে এর গর্ভাশয় (সিএইচও) কোষে বিটা-সাইক্লোডেক্সট্রিনের এই কার্যকারিতার প্রমাণ মিলেছে। নীতিনবাবু জানিয়েছেন,বিটা-সাইক্লোডেক্সট্রিনের সঙ্গে অন্যান্য রাসায়নিক মিশিয়ে তার ক্ষমতা কমানো- বাড়ানোও যায়। কোনও ওষুধ তার রাসায়নিক শৃঙ্খলের আয়তন অনুযায়ী আলফা, বিটা বা গামার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রির অ্যানালিস্ট, এলসভিয়ারের ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ফার্মাসিউটিকসের মতো বিশ্বখ্যাত পত্রিকাগুলিতেও এই গবেষণার বিভিন্ন অংশ প্রকাশিত হয়েছে। নীতিনবাবুর ব্যক্তিগত মত, সঠিকভাবে এই ওষুধের প্রয়োগে মাত্র তিন সপ্তাহেই শরীরকে ওষুধমুক্ত করা যাবে। তবে, এর জন্য ডোজের সঠিক পরিমাণ ঠিক করতে হবে। এক্ষেত্রে যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্যভাবে তিনি বলেছেন তার হলো, সাইক্লোডেক্সট্রিন শরীরে জমা হতে পারে না। তাই এ থেকে কোনও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও প্রায় নেই বললেই চলে। তবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের আগে রঞ্জকের পরিবর্তে আসল ওষুধ দিয়ে গবেষণাটি করতে হবে। তবেই ১০০ শতাংশ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হবে।
গবেষণা প্রসঙ্গে নীতিন বাবু জানিয়েছেন, প্রথমে বিভিন্ন ধরনের লিপিড নিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছিল। লিপিড হল মানুষ বা প্রাণীর কোষপর্দা এবং প্রাচীরের অন্যতম প্রধান উপাদান। এক্ষেত্রে ওষুধের ‘রেপ্লিকা’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল বিভিন্ন রঞ্জক পদার্থ। দেখা গিয়েছিল, বিটা-সাইক্লোডেক্সট্রিন দিলে রঞ্জকগুলি লিপিড ছেড়ে বেরিয়ে এসে তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এরপরে গবেষণা করা হয় সিএইচও দিয়ে। সেখানেও একই বিষয় লক্ষ্য করা গিয়েছে। কঠিন সাইক্লোডেক্সট্রিন দিলে রঞ্জকগুলি জীবন্ত কোষ ছেড়ে মিশে যাচ্ছে এই রাসায়নিকের সঙ্গে।
নীতিনবাবু জানান, এই গবেষণায় বিটা-সাইক্লোডেক্সট্রিন নামে যে রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে তার অপেক্ষাকৃত সস্তা । আলফা বা গামার ক্ষমতা আরো বেশি হলেও সেগুলি মহার্ঘ্য। তাই সেগুলি এই গবেষণায় ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। রঞ্জনের পরিবর্তে আসল ওষুধ প্রয়োগ করে গবেষণা করতে পারলে তবেই এর মূলে পৌঁছনো সম্ভব, যা সময় এবং ব্যায়সাপেক্ষ বলেই জানান নীতিনবাবু। তাই প্রাথমিক গবেষণায় সফলতা পেলেও এখনও এর পেটেন্ট নেননি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষকরা। নিজে থেকে এর বাণিজ্যিকীকরণেও উৎসাহী নন তাঁরা। এবিষয়ে কি কোচবিহার মেডিক্যাল কলেজের ফার্মাকোলজির বিভাগীয় প্রধান ডাঃ অঞ্জন অধিকারীর মতে, এ ধরনের গবেষণা সম্ভাবনাময় এবং এর থেকে নতুন ওষুধও তৈরি হতে পারে। তবে, তার আগে এর প্রায়োগের দিকটিও খতিয়ে দেখা দরকার বলেই মনে করেন তিনি।