ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো: বুদ্ধের হাতে সূচনা, পীযূষের হাতে পরিণতি

ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো: বুদ্ধের হাতে সূচনা, পীযূষের হাতে পরিণতি

কলকাতা: যিনি শিল্যান্যাশ করেছিলেন তিনি শয্যাশায়ী। খবরটুকু জানেন কিনা তাও জানা নেই। তবে, যিনি উদ্বোধন করবেন, তিনি হলেন ভারতের রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল।

দিন চলে যায়, ইতিহাস কিন্তু থেকেই যায়। ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ সালে বুদ্ধদেব বাবু এই পথের শিল্যান্যাস করে বলেছিলেন, পাতাল রেলের মত ১২ বছর লাগবে না। ৪ বছরেই রেল চলবে। কলকাতায় ভারতের প্রথম শহর হবে যেখানে গঙ্গার নীচ দিয়েই রেল চলবে। যদিও তা হয় নি, প্রায় ১১ বছর সময় লেগে গিয়েছে। কলকাতা করপোরেশনের প্রাক্তন চিফ ইঞ্জিনিয়ার দীপঙ্কর সিংহ স্মৃতিচারণ করেছেন।
“আজ থেকে প্রায় এগারো বছর আগের কথা মনে পড়ছে।  সেই দিনটা ছিলো রবিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ সাল। বিধাননগরের মঞ্চ থেকে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য উদ্বোধন করেছিলেন পূব-পশ্চিম মেট্রো রেলের কাজ। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন মাননীয় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী জয়পাল রেড্ডি। কি উদ্দীপনা। তখনতো চারিদিকে চলছে কর্মযজ্ঞ।  কেন্দ্র-রাজ্য প্রকল্প জেএনইউআরএম-এর কাজ শহর জুড়ে ও আরো কত কিছুই।  আমি তখন কোলকাতা মেট্রোপলিটান প্ল্যানিং কমিটির পরিবহন বিষয়ক সমিতির সদস্য। শহরের যানবাহনের ও মানুষের যাতায়াতের ব্যবস্থার সাথে সামগ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য পরিকল্পনা তৈরির কাজ চলছে। অপরদিকে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি বা জাইকার সহায়তায় কলকাতার বুকে জুড়ে যাচ্ছে নতুন নতুন ফ্লাইওভার।”

দীপঙ্করবাবুর কথায়, ” আরো প্রস্তাব আসছিল। তারমধ্যেই সমীক্ষা হলো ব্যারাকপুর থেকে জোকা পর্যন্ত এলআরটি বা অত্যাধুনিক হাল্কা রেল পথ, যা রাস্তার উপর দিয়ে চলবে। ব্যারাকপুরের দিক থেকে বিটি রোড, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড হয়ে মৌলালি থেকে ঘুরে ধর্মতলা হয়ে দক্ষিণ দিকে চলে যাবে।  মৌলালি স্টেশনের নকশাও হাতে পেলাম মতামত দেওয়ার জন্য।  প্রকল্প রচনা হলো শিয়ালদহ স্টেশন থেকে মহাকরণ পর্যন্ত রাস্তার কিছুটা উপর দিয়ে চলন্ত ফুটপাতের।”

ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের প্রথম ধাপ আজ যখন উদ্বোধন হওয়ার মুখে, তখন অনেকেই বুদ্ধদেবের সেই অদম্য জেদের কথা মনে করছেন। নিয়তিও অতি অদ্ভুত। যা বুধবাবুর হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে, সম্পূর্ণতা পাবে কোনও এক পীযূষ গোয়েল এবং বাবুল সুপ্রিয়র হাত ধরে। দীপংকর বাবু আরো বলেছেন, “ছোটখাটো বিষয়গুলিতে মতামত দিয়ে আপত্তি ও নিষ্পত্তির মধ্যে দিয়ে কি সজীবভাবে এগিয়ে চলা। একজন প্রযুক্তিবিদের জীবনে এটাই তো প্রাপ্তি। কোনো উপরতলার নির্দেশ বা চাপিয়ে দেওয়া নেই, শুধু দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ আছে। ছিল মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার আশ্বাস।  সমীক্ষা হচ্ছিল কলকাতা ঘিরে বড় একটি রিং রোড বা চক্রাকার পথের। যার বাইরে থাকববে বেশ কয়েকটি ট্রাক টারমিনাল। বড় ট্রাক শহরে ঢুকবেনা। বড়বাজারের বিকেন্দ্রীকরণের দীর্ঘদিনের ভাবনা বাস্তবায়িত হবে। গঙ্গার উপর দিয়ে একটা সেতু বজবজের কাছে হবে এই রিং রোডের অংশ হিসাবে।  হলদিয়া শিল্পকেন্দ্র ছুঁয়ে সেই পথ ঘুরে আবার উত্তরদিকে শহরে ঢোকার পথে যুক্ত হবে। নিবেদিতা সেতুর কাজ চলছিল। আহিরিটোলায় আরো একটি সেতু দিয়ে হাওড়া কলকাতা যোগাযোগ বৃদ্ধির ভাবনা হচ্ছিল।  বিদ্যাসাগর সেতুর সফল রূপায়ন উদ্বুদ্ধ করেছিল। ঐ রিং রোড বরাবর শহর ঘিরে একটা রেলপথের প্রস্তাবও ছিল। শহরের মধ্যে আধুনিক সিগন্যালিং ও গ্রীন করিডোর করা ছাড়াও রাস্তার আশেপাশের যত্রতত্র বিজ্ঞাপনের বোর্ড, স্তম্ভ শৃঙ্খলায় আনা, পথের দিক নির্দেশনার বোর্ড লাগানোর কাজ ও বাস যাত্রীর অপেক্ষা করার শেডের নকশার কাজতো আমার হাতেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আসলে এইসব বলছি এটাই বোঝাতে যে একটা মেট্রো রেল নয়, ছিল একটা ব্যাপক পরিকল্পনা।  এই মেট্রো রেলে রাজ্যের সরাসরি আর্থিক অংশগ্রহণ ছিল। পরে অবশ্য সেই অংশীদারি ফিরিয়ে দেওয়া হলো। সে সব কিছুই তো দেখলাম। ফিরে আসি সেই মেট্রো রেলের কাজের উদ্বোধনের কথায়। “

সেদিন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ঘোষণা করেছিলেন চার বছরে রাজ্য ও কেন্দ্র মিলে ঐ মেট্রো রেলের কাজ শেষ করবে। প্রথম মেট্রোর মতো বারো বছর দেরি হবেনা।  কিন্তু সেই কথা কথাই থাকলো। এগারো বছর লেগে গেল প্রথম পর্যায়ের উদ্বোধনে। তবুও ভালো। বিপর্যয় হলেও এগিয়েছে। রাজ্যসরকার, নগরোন্নয়ন মন্ত্রক এবং জাপান সরকার মিলে যায় প্রকল্প শুরু করেছিল। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা এই প্রকল্প হাতে নিতে চেয়েছিলেন , কিন্তু পাননি। আবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার তিনি চেয়েছিলেন এই প্রকল্প যাতে রাজ্য সরকার পুরোপুরি পায়। কিন্তু, পরবর্তী কালে তিনি মতামত পরিবর্তন করেন। ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর সব দায় ছেড়ে দেয় রাজ্য। রেল মন্ত্রক এবং নগরন্নয়ন মন্ত্রক কাজ এগিয়ে নিয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *