বেজিং: পৃথিবী ধ্বংসের মুখে বলছেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা থেকে শুরু করে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক গবেষকরাও। তবে বিগত দু-এক বছর ধরে সেই আশঙ্কাকেই আরো প্রবল করে তুলেছে প্রাকৃতিক ভারসাম্যে অস্বাভাবিকতা, একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা এবং নানান কারণে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ ও পারস্পরিক অস্থিরতা। দেশগুলির মধ্যে চাপা ক্ষোভ থেকে যুদ্ধের বাতাবরণও তৈরি হয়েছে। আর এই তৃতীয় বিশ্বের যুগে উন্নত বা উন্নয়নশীল যেকোনো দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ মানেই আধুনিক অস্ত্র প্রয়োগের ভয়াবহ পরিণামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে গোটা বিশ্বকে।
তবে এই পরিনামের কথা চিন্তা ভাবনার মধ্যে থাকলেও প্রতিটি দেশই নিজের মতন করে বাড়িয়ে তুলছে সামরিক ক্ষমতা এবং তা অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে। সামরিক শক্তি বাড়াতে সব রাষ্ট্রই নিজের নিজের মতন করে অত্যাধুনিক হাতিয়ার নিয়ে চিন্তাভাবনা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই অত্যাধুনিক অস্ত্রের অন্যতম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য জৈব রাসায়নিক অস্ত্র এবং জেনেটিক্যাল মিউটেশন। এই ধরনের অস্ত্র কীভাবে মানব সভ্যতার ধ্বংস ডেকে আনবে তা নিয়ে এ পর্যন্ত বহু ভবিষ্যৎ বাণী আছে।
এমন কি কাল্পনিক ভাবে চলচ্চিত্রের পর্দাতেও উঠে এসেছে এই ভয়ঙ্কর বাস্তবিক প্রসঙ্গ। একটি ভাইরাস সংক্রমণ ঘটছে আর মানুষ নানান সমস্যার শিকার হচ্ছে। এক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের পর্দায় ফুটে উঠেছে ভাইরাসের সংক্রমণে মানুষের জিনগত পরিবর্তন এবং এর ফলে তার পশু বা দানবের মতো আচরণ। সেখানে দেখানো হয়েছে একটি ভাইরাস আক্রান্ত মানুষ থেকে কিভাবে গোটা বিশ্বকে গ্রাস করছে সেই ভাইরাস। বিশ্বে ত্রাস সৃষ্টিকারী এমনই এক ভাইরাস নতুন করোনা (১০১৯এনসিভিও) যা চীনে মহামারী আকার নিয়েছে এবং ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের অন্তত ১৫ টি দেশ। এই মুহূর্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘুম কেড়েছে এই ভাইরাস। চিন্তাভাবনা চলছে আন্তর্জাতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার বিষয়ে। করোনাভাইরাস পশুর শরীরে সংক্রমণ ঘটায় বলেই জানতেন বিশেষজ্ঞরা।
মানুষের শরীরে কখনো বা দেখা গেলেও নতুন এই করোনাভাইরাস এর প্রকৃতি অনেকটাই আলাদা বলে মনে করছেন তারা। এই ভাইরাসের মধ্যে বিশেষ একটি পরিবর্তন এর সংক্রমণ ক্ষমতাকে আরো জোরদার করে তুলেছে এবং মানুষের শরীরে একবার প্রবেশ করলে তা সহজেই অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম। আর সন্দেহের সূত্রপাত এখান থেকেই। কি এমন পরিবর্তন হলো? কীভাবেই বা এই পরিবর্তন হলো? এই পরিবর্তনকে প্রাকৃতিক নাকি কারো মস্তিষ্কপ্রসূত? তা নিয়ে এর মধ্যেই জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছে বিশেষজ্ঞ থেকে সাধারণ মানুষের মনে।
এই সন্দেহকেই জোরদার করে তুলেছে ইজরায়েলের জীবাণু অস্ত্রের বিশেষজ্ঞরা। তাদের মধ্যে গোপনে এই ভাইরাসের চাষ হচ্ছে ইউহানের জৈব রাসায়নিক মারণাস্ত্র তৈরির কারখানা বায়ো-সেফটি লেভেল ৪ ল্যাবোরেটরি। সহমত পোষণ করেছে ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। মার্কিন পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্ট এই দাবিকেই সমর্থন করেছে।
অসাবধানতাবশত কোনভাবে এই গবেষণাগার থেকেই ছড়িয়েছে ভাইরাসের সংক্রমণ। রেডিও ফ্রি এশিয়া গত সপ্তাহে উহান টেলিভিশন ২০১৫ সালের একটি প্রতিবেদনের রিপোর্ট তুলে ধরেছে, যা চীনের এর সবচেয়ে উন্নত ভাইরাস গবেষণাগার উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি নামে পরিচিত একটি গবেষণাগার কেন্দ্র করে। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে,এই ল্যাবরেটরিটি চীনের একমাত্র ঘোষিত সাইট যা মারাত্মক ধরনের ভাইরাস নিয়ে কাজ করতে সক্ষম।
ইজয়েলের প্রাক্তন সামরিক গোয়েন্দা অফিসার, ড্যানি শোহম, যিনি চীনা জৈবিক যুদ্ধের অধ্যয়ন করেছেন,তিনিও বলেছেন যে এই প্রতিষ্ঠানটি বেইজিংয়ের গোপন বায়ো-অস্ত্র কর্মসূচির সাথে যুক্ত। ইজয়েলের এই প্রাক্তন সামরিক গোয়েন্দা অফিসার ওয়াশিংটন টাইমসকে বলেছেন “ইনস্টিটিউটের কয়েকটি পরীক্ষাগারগুলি সম্ভবত চীনা জৈবিক অস্ত্র নিয়ে গবেষণা এবং বিকাশের ক্ষেত্রে নিযুক্ত হয়েছে, যদিও তা চীনের বায়োলজিক্যাল ওয়েপনসের সারিবদ্ধকরণের মূল ব্যবস্থা হিসাবে নয়,”। এই সংবাদমাধ্যমকে একটি ইমেইল করে তিনি জানিয়েছেন জৈবিক অস্ত্রের উপর কাজ বেসামরিক-সামরিক যৌথ গবেষণার অংশ হিসাবে পরিচালিত হয় এবং এটাই তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।
ড্যানি শোহাম মেডিকেল মাইক্রোবায়োলজিতে ডক্টরেট করেছেন। ১৯৭০ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি মধ্য প্রাচ্য এবং বিশ্বজুড়ে জৈবিক এবং রাসায়নিক যুদ্ধের জন্য ইজরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের সিনিয়র অ্যানালিস্ট ছিলেন। তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
যদিও চীন কোনও আপত্তিকর জৈবিক অস্ত্র থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে, তবে গত বছর পররাষ্ট্র দফতরের একটি প্রতিবেদনে চীনের গোপন জৈব যুদ্ধের কাজের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। এদিকে এবিষয়ে জানতে চাওয়া হলে চিনের দূতাবাসের মুখপাত্রের তরফ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
চীন কর্তৃপক্ষের দাবি করোনা ভাইরাসের উৎস সম্পর্কে তাদেরও কোনো ধারণা নেই। চাইনিজ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের পরিচালক গাও ফু রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন যে প্রাথমিক লক্ষণগুলি ইঙ্গিত দিয়েছে যে উহানের একটি সামুদ্রিক বাজারে বিক্রি হওয়া বন্য প্রাণী থেকে ভাইরাসটির উদ্ভব হয়েছিল।
এক মার্কিন কর্মকর্তার মতে, পুরো বিষয়টি একটি অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছে যেখানে চীনের কয়েকটি সোশ্যাল মিডিয়া এমন গুজব রটানো হচ্ছে যে ভাইরাস ওয়েপন ব্যবহার করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত রয়েছে। এক্ষেত্রে সন্দেহ আরও জোরদার হচ্ছে যে চীনের কোন পরীক্ষাগার থেকেই এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে এবং এই বিষয়টি চাপা দেওয়ার জন্যই দায়ভার আমেরিকার ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে।
ইজরায়েলের সেনা গোয়েন্দাদের উদ্ধৃত করে এখানকার দুটি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর ব্যাপক আধুনিকীকরণ, ছাঁটাই প্রক্রিয়া ও প্রযুক্তিগত মানোন্নয়ন করছে চীন। পাশাপাশি জীবাণু অস্ত্র ও রাসায়নিক অস্ত্র নিয়েও গবেষণা চলছে জোর কদমে।
এর আগে জীবাণু অস্ত্র নিয়ে গবেষণার অঙ্গ হিসেবে সার্স জাতীয় ভাইরাস নিয়েও গবেষণা করছে চীনের সামরিক বাহিনীর গবেষণাগার। মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্ট ও ইজরায়েলের মোসাদের দাবি, বিনা রক্তপাতে শত্রুদেশ গুলির উপর দখল নিতে অনেকদিন ধরেই জীবাণু অস্ত্র নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। তাদের নির্দেশেই এই গবেষণা চলছে। কিন্তু এই গবেষণা যে দুর্ঘটনাবশত তাদের দেশের জন্যই প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে এবং দেশজুড়ে মহামারীর আকার নেবে তা হয়তো ভাবতে পারেননি গবেষকরা। যা এখন বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অস্ত্র চুক্তির সম্মতি সম্পর্কে বার্ষিক স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে চীন জৈবিক যুদ্ধের সমর্থনে এই ধরনের কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত। ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের প্রতিবেদনেও স্পষ্টতই জানিয়েছে যে মারণাস্ত্র হিসেবেই চীন এই নতুন করোনা ভাইরাসকে তৈরি করেছে। ইজয়েলের প্রাক্তন সামরিক গোয়েন্দা অফিসার, ড্যানি শোহম যদিও জানিয়েছেন যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর কোন তথ্য প্রমাণ নেই তবে নাশকতা বা অন্তর্ঘাতের উদ্দেশ্যেই চীনের কোনও বিজ্ঞানী বা গুপ্তচর এই ভাইরাস ছড়িয়েছেন এবং এনিয়ে ধারাবাহিক গবেষণার পরেই করোনাভাইরাস এর উৎস সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে জানা যাবে।