বাংলা ভাষাকে দেবনাগরী হরফে লেখার দাবি, বিজেপি সাংসদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ‘ঐক্য বাংলা’

ভাষাবিদ সুনীতিকুমার দেখিয়েছিলেন বাংলা এসেছে প্রাকৃত ভাষা মাগধি থেকে, অর্থাৎ শুধুমাত্র সংস্কৃত বাংলার একমাত্র উৎস ভাষা নয়। তাই ২২ টি দাপ্তরিক ভাষাই দেবনাগরী (হিন্দি) হরফে লেখার বিজেপি সাংসদ শিব প্রতাপ শুক্লার দাবি হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘৃণ্য চক্রান্ত বলেই মনে 'ঐক্য বাংলা'।

কলকাতা: বিজেপি নেতৃত্বদের ‘বাঙালি বিদ্বেষী’ মনোভাব বিভিন্ন ক্ষেত্রেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এবার এই আগুনেই ঘৃতাহুতি দিলেন বিজেপি সাংসদ শিব প্রতাপ শুক্লা। গত সোমবার রাজ্যসভায় দুটি প্রবল বিতর্কিত দাবি তোলেন পদ্মশিবিরের এই সাংসদ। তিনি দাবি জানালেন ভারতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইনের, এবং অভাবনীয়ভাবে এও বললেন, “ভারত রাষ্ট্রে মানুষ হিন্দি বোঝে, তাই ২২টি দাপ্তরিক ভাষাই দেবনাগরী (হিন্দি) হরফে লেখা উচিত।” 

এর বিরুদ্ধে এবার পথে নামলেন বাংলার প্রথম মুক্ত পন্থী বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগঠন 'ঐক্য বাংলা'। 'ঐক্য বাংলা'- র পাল্টা দাবি বাঙালি সহ ভারতের অহিন্দি জাতিগোষ্ঠীর প্রতি জনপ্রতিনিধির এই মনোভাব চূড়ান্ত অপমানজনক মানসিকতার পরিচয়। তাই বিজেপি সাংসদের এহেন দাবির প্রতিবাদে ১৭ মার্চ মঙ্গলবার  সন্ধ্যায় উত্তর কলকাতার শ্যামবাজার অঞ্চলে একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে এই সংগঠন৷ সংগঠনের এক সদস্য বীরেশ্বর দাশগুপ্তর প্রশ্ন,”আমরা কি দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক? ভারতে লিঙ্গ, জাত, ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য অসাংবিধানিক হলেও, ভাষার ভিত্তিতে এই চূড়ান্ত লাঞ্ছনা, অপমান, অধিকার কেড়ে নেওয়ার সংস্কৃতি কেন অবৈধ ও বেআইনি নয়? ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের জনপ্রতিনিধি বলে, অহিন্দিভাষী নাগরিকের প্রতি এই ঔপনিবেশিক উক্তি করেও পার পেয়ে যাবেন?” 

অন্যদিকে সংগঠনের আর এক সদস্য কাওসার হক মন্ডল  ভাষাচার্য সুনীতিকুমারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন ভাষাচার্য সুনীতিকুমার কে, যিনি দেখিয়েছিলেন বাংলা এসেছে প্রাকৃত ভাষা মাগধি থেকে, অর্থাৎ শুধুমাত্র সংস্কৃত বাংলার একমাত্র উৎস ভাষা নয়। তিনি স্পষ্টভাষায় জানিয়েছেন, “হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘৃণ্য চক্রান্তেরই একটা অংশ সাংসদের এই উক্তি।” তবে তিনি আশাবাদী যে “বাঙালি জাতীয়তাবাদের জাগরণের ফলে – হিন্দি রাষ্ট্রভাষা – এই ভুল বাঙালির অনেকটাই ভেঙেছে। আগামী দিনে ঐক্য বাংলা হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বাঙালিকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখার সব রকম চক্রান্ত রুখে দেবার লড়াই চালিয়ে যাবে।”

অপর এক সদস্য দেবায়ন সিংহের কথায়, “জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন করতে চায় কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কোন রাজ্য গুলোর জন্য বেশি দরকার? সরকারি তথ্য অনুসারে বাঙালির জন্মহার ১.৬% এর কাছাকাছি, সেখানে হিন্দি বলয় রাজ্যগুলোতে সেটা ৩% এর কাছাকাছি। তাহলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কোথায় দরকার?”  তিনি আরও বলেন “আপনাকে ধর্মের টনিক দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হবে মুসলমানদের জন্য জনসংখ্যা বেশি বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু জেনে রাখুন – বাংলার মুসলিম জন্মহার ২.২%। উত্তর প্রদেশ রাজস্থান বিহার ঝাড়খণ্ডের হিন্দু জন্মহার ২.৫%-র উপরে, মুসলিম জন্মহার ২.৯% এর উপরে। তাহলে জন্মহারে সমস্যা কাদের বেশি?” 

২০১১ সালের ল্যাংগুয়েজ সেন্সাস অনুসারে  ৪৩.৬৩% ভারতীয়র মাতৃভাষা হিন্দি। সদস্য রেশমি মুখার্জি বলেন, “উত্তর ভারতীয় হিন্দি সম্রাজ্যবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি বাঙালিকে ভাগ করতে চাইছে। কিন্তু ঐক্য বাংলা নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের প্রতিজ্ঞা – বাঙালি কি আমরা ভাগ করতে দেবো না। বাঙালি ভাই বোনেরা আমরা আজকেও এক আছি – এই বাঙ্গালী ঐক্য কে আমরা, ঐক্য বাংলা, নষ্ট হতে দেবো না।”  বাঙালিদের প্রতি এই বিদ্বেষ বা বঞ্চনামূলক মনোভাবের বিরুদ্ধে অন্যান্য বাঙালি সংগঠনগুলিকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন ঐক্য বাংলার সাধারণ সম্পাদিকা সুলগ্না দাশগুপ্ত। ঐক্য বাংলার সংগঠনের বয়স মাত্র একমাস। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে এই সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বাঙালি ও বাংলা ভাষার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এরমধ্যেই নানান কর্মসূচি ও প্রতিবাদমূলক কর্মসূচি পালন করে চলেছে। যেমন, শপিং মলে বাঙালি গায়ক নিগ্রহের প্রতিবাদ, ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে অভিনব সমীক্ষা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সপ্তাহ ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen − 18 =