কলকাতা: প্রায় পাঁচ দশক আগের কথা৷ শিল্পের আকর্ষণে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে ভারতে এসেছিলেন ইউরোপের এক তরুণী। কিন্তু ভারতে আসার পর শিল্পীর প্রেমে পড়ে যান তিনি। ভালবেসে বিয়েও করেন তাঁরা৷ তবে একসঙ্গে থাকা হয়নি তাঁদের৷ নববধূকে ফিরতে হয় নিজের দেশ সুইডেনে৷ সঙ্গে নিয়ে যান স্বামীর প্রতিশ্রুতি, ‘আবার দেখা হবে’৷ এর পর সঙ্গীর পথ চেয়ে এক বছরেরও বেশি সময়ের অপেক্ষা৷
অবশেষে তাঁর জীবনসঙ্গী এলেন। অনেক কষ্ট সহ্য করে টানা চার মাস সাইকেল চালিয়ে পৌঁছলেন সুইডেনে৷ ফের ধরলেন স্ত্রীর হাত৷ ভারত থেকে সুইডিস স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন দিল্লির যুবক প্রদ্যুম্নকুমার মহানন্দিয়া।
প্রদ্যুম্ন পেশায় এক জন শিল্পী৷ তাঁর আঁকার প্রশংসা পৌঁছেছিল সুদূর সুইডেনে থাকা শার্লট ভন স্কেডভিনের কানে। ১৯ বছরের ছাত্রী শার্লট তখন প্রদ্যুম্নের শিল্পে বুঁদ। কী ভাবে তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন তা ভেবে আকুল হয়ে উঠেছিলেন। ভারত এবং সুইডেনের মধ্যে দূরত্ব যে বিস্তর! তবুও শিল্পের টানে তিনি পাড়ি দেন ভারতের উদ্দেশে৷ ভ্যানে চেপে ২২ দিনের যাত্রা শেষে এদেশে পৌঁছলেন তিনি। সাল ১৯৭৫৷ নয়াদিল্লিতে এসে প্রদ্যুম্নের সঙ্গে দেখা করলেন শার্লট। কিন্তু, প্রদ্যুম্নের শিল্প নয়, শিল্পীরও প্রেমে পড়ে গেলেন তিনি৷ আবদার করলেন, তাঁর একটা ছবি এঁকে দেওয়ার জন্য৷ গুণমুদ্ধ তরুণীর সেই অনুরোধ ফেরাতে পারেননি প্রদ্যুম্নও। কারণ তিনিও যে শার্লটের সারল্যে মন হারিয়েছিলেন৷
এর পর উভয়েই ভালবাসার কথা স্বীকার করে সাত পাকে বাঁধা পড়েন৷ তবে কোনও এক কারণে দেশে ফিরে যেতে হয় শার্লটকে৷ তিনি প্রদ্যুম্নকে সুইডেন যাওয়ার কথা বলেন৷ যাওয়ার ইচ্ছাও ছিল প্রবল৷ কিন্তু, সেই সময় শার্লটের হাত ধরে দেশ ছাড়তে পারেননি শিল্পী৷ তখনও যে তাঁর পড়াশোনা চলছে।
তবে তিনি শার্লটকে কথা দিয়েছিলেন, এক দিন ঠিক সুইডেনে যাবেন। তাই পড়াশোনা শেষ হতেই সুইডেন যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন প্রদ্যুম্ন। কিন্তু , বাধ সাধল টাকা৷ তাঁর কাছে বিমানের টিকিট কাটার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। অগত্যা নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে কিনে ফেলেন একটি সাইকেল।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রদ্যুম্ন জানান, টানা চার মাস তিন সপ্তাহ সাইকেল চালিয়ে ভারত থেকে ইউরোপে পৌঁছেছিলেন তিনি। প্রদ্যুম্নর কথায়, ‘‘১৯৭৭ সালে ২২ জানুয়ারি ভারত থেকে যাত্রা শুরু করি৷ রোজ প্রায় ৭০ কিলোমিটার রাস্তা সাইকেল চালিয়ে গিয়েছি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘পথে বহু বাধাবিপত্তির এসেছে। এমনও দিন গিয়েছে যখন মাঝরাস্তায় সাইকেল খারাপ হয়ে গিয়েছে। কী করব কোনও দিশা খুঁজে পাইনি৷ আবার বহু দিন এমন হয়েছে যে, এক টুকরো খাবারও দাঁতে কাটিনি। না খেয়েই একটানা সাইকেল চালিয়ে গিয়েছি।’’
১৯৭৭ সালের ২৮ মে সুইডেন পৌঁছন তিনি। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক, ইস্তানবুল এবং ভিয়েনা হয়ে গোথেনবার্গে যান। সেখান থেকে ট্রেনে চেপে সুইডেনের বোরাস শহরে পৌঁছন। ওই সাক্ষাৎকারে প্রদ্যুম্ন স্ত্রীর প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘শার্লট যখন আমার পরিবারের সঙ্গে প্রথম দেখা করতে এসেছিল, তখন শাড়ি পরেছিল। আমি জানি না ও কী ভাবে সবটা সামলেছিল।’’ ভারতে বিয়ে হলেও সুইডেন যাওয়ার পর ফের শার্লটকে বিয়ে করেন প্রদ্যুম্ন।
প্রদ্যুম্নের কথায়, ১৯৭৫ সালে তিনি শার্লটকে যতটা ভালবাসতেন, আজও ঠিক ততটাই ভালবাসেন৷ তবে সুইডেন যাওয়ার পর নতুন জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বেশ সমস্যা হয়েছিল তাঁর। কিন্তু শার্লট প্রতি মুহূর্তে পাশে ছিলেন। বর্তমানে স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে নিয়ে সুইডেনেই থাকেন প্রদ্যুম্ন। সেখানেই নিজের শিল্প নিয়ে ব্যস্ত জীবন তাঁর৷
” style=”border: 0px; overflow: hidden”” title=”YouTube video player” width=”560″>