কলকাতা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদ প্রথমে লিবিয়া, তারপর পাকিস্তানে আত্মগোপনের চেষ্টা করেছিলেন৷ কিন্তু সেখানে সুবিধা করতে পারেননি তিনি৷ এরপর ভারতে বিভিন্ন রাজ্য ঘুরে কলকাতায় ঘর ভাড়া নেন মাজেদ৷ রীতিমতো আটঘাঁট বেঁধেই পরিচয় বদলে কলকাতায় থাকতে শুরু করেন তিনি৷ তাঁর কাছে ছিল ভারতের নাগরিকত্বের যাবতীয় প্রমাণ৷ ছিল ভারতীয় পাসপোর্ট, আধার কার্ড এবং সচিত্র ভোটার কার্ড৷ এ রাজ্যে তাঁর পরিচয় ছিল ‘আবদুল মজিদ’৷ কী করে ভারতের নাগরিকত্ব আদায় করেছিলেন মাজেদ? তবে কি তাঁর আত্মগোপনে মদত করেছিল এরাজ্যেরই কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব? উঠতে শুরু করেছে একাধিক প্রশ্ন৷
কলকাতায় প্রায় ২৩ বছর ছিলেন বঙ্গবন্ধুর এই খুনি৷ ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে আওয়ামি লিগ সরকার গঠন হওয়ার পর রাতারাতি দেশ ছেড়েছিলেন মাজেদ। তারপর লিবিয়া পাকিস্তান হয়ে কলকাতায় আসেন তিনি৷ তাঁর পার্ক স্ট্রিটের ভাড়া বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে ভারতীয় পাসপোর্ট৷ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ২০১৭ সালে ওই পাসপোর্ট বানিয়েছিলেন মাজেদ৷ ভেরিফিকেশন করেছিল পার্ক স্ট্রিট থানা পুলিশ৷ পাসপোর্টে জন্মস্থান হিসেবে উল্লিখিত ছিল হাওড়ার নাম৷ ভারতের নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে তাঁর কাছে ছিল আধার কার্ড৷ তাঁর আধার কার্ড নম্বর হল ৭৯৪১ ৯৫৯১ ২৮৬৪। ২০১২ সালে ভোটার কার্ডও বানিয়ে ফেলছিলেন মাজেদ৷
কলকাতা থেকে বাংলাদেশে দুটি ফোন নম্বরে প্রতিদিন ফোন করতেন আবদুল মাজেদ৷ ওই নম্বর দুটি হল +৮৮০১৫৫২৩৮৭৯১৩ এবং +৮৮০১৭১১১৮৬২৩৯। কলকাতায় তাঁর কাছে যে দু’টি সিমকার্ড ছিল, সেগুলিও কিনেছিলেন তাঁর স্ত্রীর নামে৷ অর্থাৎ তাঁর নিজের নামে কোনও ফোন নম্বর ছিল না৷ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা মনে করছেন, বাংলাদেশে মাজেদের পরিবারের সদস্যদের ফোনে নিয়মিত আড়ি পাততো সে দেশের গোয়েন্দা সংস্থা। সেখান থেকেই মাজেদের হদিশ পান তারা। তৈরি করা হয় মাজেদকে গ্রেফতারের নীল নকশা৷ এদিকে, কলকাতায় বঙ্গ বন্ধুর খুনির অবস্থান জানতে খুব সম্ভবত বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের সাহায্য করেছিল ভারতীয় গোয়েন্দা৷ যদিও এই বিষয়ে কোনও দেশের তরফেই বিবৃতি দেওয়া হয়নি৷
মাজেদের স্ত্রী সেলিনা ওরফে জরিনা বেগমকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দারা৷ তিনি জানান, ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে চলতেন মাজেদ। কোনও কাজে এক মিনিটেরও হেরফের হতো না তাঁর৷ এমনকী খেতে দিতে সামান্য দেরি হলে রেগে আগুন হয়ে যেতেন৷ মার্চের মাঝামাঝি ভারত বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঢুকেছিলেন মাজেদ– এই তথ্যের সূত্রে ঢাকার মিরপুর থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট।
এদিকে, মাজেদ নিখোঁজ রহস্যের তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা সিসিটিভির ফুটেজ খতিয়ে দেখে নিশ্চিত হয়েছেন যে, বেডফোর্ড লেনের বাড়ি থেকে বেরনোর পর তাঁকে কেউ জোর করে অপহরণ করেনি। তাহলে কোনও না কোনও প্রমাণ নিশ্চই মিলত৷ অর্থাৎ স্বেচ্ছাতেই ওই চার ষণ্ডামার্কা লোকের সঙ্গে গিয়েছিলেন মাজেদ। তবে কি সেদিন মাজেদের পরিচিত কাউকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন গোয়েন্দারা? রয়ে গিয়েছে সেই প্রশ্নটিও৷
গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, সুদের কারবার ও টিউশনির টাকায় সংসার চলত মাজেদের৷ তবে সম্প্রতি তালতলা এলাকায় ২৫ লাখ টাকা দিয়ে একটি ফ্ল্যাট বুক করেছিলেন তিনি। গোয়েন্দের সন্দেহ, সম্ভবত বাংলাদেশ থেকে টাকা আসত তাঁর কাছে। কিন্তু সেই ফ্ল্যাটে আর যাওয়া হয়নি তাঁর৷