সিদ্ধার্থ বোস: কলকাতার ইতিহাসের পাতা উল্টালেই বেরিয়ে পরে হাজার বছরের পুরনো একাধিক রহস্যের জাল। ১৮৮৭ সালের ২৫ মে, ৭৫০ জন যাত্রী বোঝাই একটি জাহাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদাসীনতায় উলটে গিয়েছিল মাঝ সমুদ্রে। যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন ভারতীয় রমণী।
হাওড়ার জগন্নাথ ঘাটের পাশে ছোটুলাল-দূর্গাদাস ঘাটের দক্ষিণ দিকে দেওয়াল লাগোয়া একটি সিঁড়ি দিয়ে আজও লোক চলাচল করে। সেখানেই রয়েছে একটি ইংরেজি-বাংলায় লেখা ফলক। যাতে লেখা আছে, “১৮৮৭ সালের ২৫ মে তারিখের ঝটিকাবর্ত্তে স্যার জন লরেন্স বাষ্পীয় জাহাজের সহিত যে সকল তীর্থযাত্রী, অধিকাংশ স্ত্রী লোক, জলমগ্ন হইয়াছেন তাহাদিগের স্মরণার্থ কয়েকটি ইংরাজ রমণী কর্তৃক এই প্রস্তর ফলকখানি উৎসর্গীকৃত হইল।“ এই মাইলফলক এর পিছনে কোম্পানির নিজের স্বার্থ জড়িত ছিল বলাই যায়। এই ফলকের ইতিহাস জানতে যেতে হবে হাটখোলার দত্ত পাড়ায়। দত্তপাড়ার গলির মুখে ১৩ নম্বর বাড়িটির দেওয়ালে আরও একটি ফলক দেখা যায়। ওই ফলকের লেখা থেকে জানা যায়, এই বাড়ির গৃহকর্তা শ্যামাচরণ দত্ত চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী ১২৯৪ বঙ্গাব্দের ১২ জ্যৈষ্ঠ পুরী যাত্রার সময় সমুদ্রে জাহাজডুবির ফলে মারা যান।
১৮৮৭ সালের একটি ইংরেজি দৈনিক “ইংলিশম্যান” থেকে জানা গিয়েছে, ওই সময় সমুদ্রপথে যে সমস্ত কোম্পানি ব্যবসা শুরু করেছিল তার মধ্যে ক্লাইভ স্ট্রিটের ‘ম্যাকলিন অ্যান্ড কোম্পানি’ ছিল অন্যতম। সেই সময় যেহেতু রেলপথ তৈরি হয়নি, তাই পুরী যেতে হলে, সমুদ্রপথে প্রথমে যেতে হত বালেশ্বর। তারপর সেখান থেকে জলপথেই যেতে হত কটক৷ সেখান থেকে বিভিন্ন যানবাহনে পৌঁছতে হত পুরীতে। ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকায় ওই বছর ২৪ মে কোম্পানি’র জাহাজ ছাড়ার বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ম্যাকলিন অ্যান্ড কোম্পানি’র জাহাজ ‘স্যার জন লরেন্স’ বালেশ্বরের চাঁদবালীর দিকে রওনা হবে ২৫ মে৷ সেখান থেকে ২৭ মে ফিরে আসবে কলকাতায়।
অন্যদিকে, ওই পত্রিকায় একই সালের ২৫মে তারিখের আবহাওয়ার খবর থেকে প্রমাণ মেলে, জাহাজ ছাড়ার দিন বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণাবর্তের প্রভাবে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে। ঝড়ের সংকেত অনুযায়ী তাতে বলা হয়েছিল, মেদিনীপুর ও কটকের মাঝামাঝি এলাকায় ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সংবাদপত্রে এই দুর্যোগের হুঁশিয়ারি থাকা সত্ত্বেও বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশে ম্যাকলিন কোম্পানি সেদিন যথারীতি যাত্রী বোঝাই জাহাজ কোলাঘাট থেকে ছেড়ে দেয়। এরপর আর ওই জাহাজের কোনও হদিশ মেলেনি৷
গত ২৭ মে তারিখের খবর থেকে সেদিনের প্রবল ঝড়ের ধ্বংসলীলার কথা জানা যায়। এমনকি হুগলী নদীর জল সেদিন স্ট্রান্ড রোডের ওপর উঠে গিয়েছিল। নদীতে থাকা ডিঙি-নৌকা ভাসছিল রাস্তার ওপর। খবরের লেখা থেকে জানা যায়, আর সামান্য বৃষ্টি হলে ভেসে যেত হেয়ার স্ট্রিটও। এর সঙ্গেই যাত্রীবাহী জাহাজ ‘স্যার জন লরেন্স’ ও মালবাহী জাহাজ ‘বিট্রিভার’-এর নিখোঁজ হওয়ার খবর প্রকাশিত হয় সেদিন।
এরপর, ইংলিশম্যান সংবাদপত্রের ১৮৮৭ সালের ২ জুনের খবর থেকে এই মৃত্যু রহস্যের পর্দা ওঠে। যেখান থেকে জানা যায়, ওই দিন ‘পোর্ট-অফিসার’-এর তরফ থেকে বলা হয়েছিল, ‘রিস্লিউট’ নামের এক জাহাজ কলকাতা ফেরার পথে গঙ্গার মোহনা বরাবর একাধিক মৃতদেহ ভেসে যেতে দেখেছে, তাদের মধ্যে দু’-একজন পুরুষ, বাকি সবই মহিলাদের মৃতদেহ। সেই সময় যে কটি মৃতদেহ উদ্ধার করা গিয়েছিল তার মধ্যে ছিলেন ‘স্যার জন লরেন্স’ জাহাজের ক্যাপ্টেন আরভিং৷ যার থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, ওই দিন পুরী অভিমুখে রওনা হওয়া যাত্রীবাহী জাহাজটি ভয়ঙ্কর ঝড়ের মুখে পড়েই ধ্বসং হয়ে গিয়েছিল৷ মৃতদেহগুলির মধ্যে এমন দৃশ্যও দেখা যায়, যেখানে সন্তান তার মায়ের বুকে দু’হাত জড়িয়ে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। সেদিন সাগরদ্বীপের চড়ায় ক্ষতবিক্ষত এরকম আরও ১১জন মহিলার মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল।