বিদ্যাসাগর: আধুনিক সমাজ গঠন, উপযোগী মানুষ গড়া ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য

বিদ্যাসাগর: আধুনিক সমাজ গঠন, উপযোগী মানুষ গড়া ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য

অনিমেষ হালদার: ১৮৬৬ সালের মাঝামাঝি সারাদেশের সাথে এ রাজ্যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ চলছে। চারিদিকে একমুঠো ভাতের জন্য হাহাকার। অনাহারে প্রাণ হারাচ্ছে বহু মানুষ। কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে সেসময় নিরন্ন মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার একটা ব্যবস্থা হয়েছিল। তখন কিছু স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে “মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন” এর একজন প্রশাসককেও ভাত-ডাল-তরকারি পরিবেশন করতে দেখা যায়। এই দুর্ভিক্ষের সময় এই ব্যক্তি নিজের উদ্যোগে মেদিনীপুরে তাঁর গ্রামে অন্নসত্রের আয়োজন করলেন। এই খবর ছড়িয়ে পড়ায় দিনদিন ভিড় বাড়তে থাকে অভুক্ত মানুষের। তখন এই ব্যক্তি বললেন, “যত টাকা খরচ হয় হোক, কেউ যেন অভুক্ত না থাকে। সকলেই যেন খেতে পায়।” 

অন্নসত্রে অনেক মেয়েরা আসে যাদের পেটে ভাতই নেই আর মাথার চুলে তেল জুটবে কোথা থেকে! ঐ ব্যক্তির নির্দেশে রুক্ষ মাথার তেলের ব্যবস্থাও হলো। পাছে ডোম,মুচি,হাড়ি এইসব নিচু জাতের মেয়েদের সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যায় সেই আশঙ্কায় যারা তেল বিলির দায়িত্বে ছিল তারা অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে তেল দিতে থাকে। এটা বুঝতে পেরে এগিয়ে এলেন ওই ব্যক্তি। নিজে হাতেই নিচু জাতের গরীব দুঃখিনীদের রুক্ষ চুলে তেল মাখিয়ে দিলেন। এই ব্যক্তিই হলেন সব ধরনের সংস্কারমুক্ত খাঁটি আধুনিক মানুষ মানবতাবাদী বিদ্যাসাগর। পরবর্তীকালে এই ঘটনা শুনে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন-  “আমাদের হৃদয় যে ভক্তিতে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে, তাহা বিদ্যাসাগরের দয়া অনুভব করিয়া নহে – তাঁহার দয়ার মধ্য হইতে যে একটি নিঃসঙ্কোচ বলিষ্ঠ মনুষ্যত্ব পরিস্ফুট হইয়া উঠে, তাহা দেখিয়া আমাদের এই নীচজাতির প্রতি চিরাভ্যস্ত ঘৃণাপ্রবণ মনও আপন নিগূঢ় মানবধর্মবশত ভক্তিতে আকৃষ্ট না হইয়া থাকিতে পারে না।”

তৎকালীন সমাজের কুপমুণ্ডকতা, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামীর বেড়াজাল ভেদ করে নবজাগরণের আদর্শে উদ্ভাসিত হয়ে তিনি মানুষকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে যেভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন তা ভাষায় বর্ণনা করা খুবই কঠিন এবং কষ্টসাধ্য। তার জীবন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বলেছেন- “অণুবীক্ষণ নামে একরকম যন্ত্র আছে; তাহাতে ছোট জিনিসকে বড় করিয়া দেখায়; কিন্তু বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত বড় জিনিসকে ছোট দেখাইবার জন্য নির্মিত যন্ত্র স্বরূপ।” বিদ্যাসাগর মহাশয় একদিকে বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি ভাষা সহ বিভিন্ন বিষয়ে পণ্ডিত ছিলেন, অন্যদিকে 'বর্ণ পরিচয়', 'কথামালা',  'বোধোদয়' সহ 'শকুন্তলা', 'সীতার বনবাস' প্রভৃতি রচনার মাধ্যমে বাংলা গদ্য সাহিত্যের দ্বার উদ্ঘাটন করেছেন। আর তাই বিদ্যাসাগর সম্পর্কে “প্রাচীন ঋষির ন্যায় প্রতিভা ও প্রজ্ঞা…” – একথা বলেছিলেন মাইকেল মধসূদন দত্ত। কিন্তু এই গুণগুলো সব নয়, তাঁর চরিত্রের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো বিশ্বকবির কথায় “অজেয় পৌরুষ” এবং “অক্ষয় মনুষ্যত্ব”।

মানুষের উপর তৎকালীন সময়ে যেভাবে একের পরে এক সামাজিক অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ নামিয়ে আনা হয়েছিল তা দেখে তিনি শুধুমাত্র কষ্ট পেয়েছেন বা ব্যথিত হয়েছেন তা নয়, এর থেকে প্রতিকারের উপায় বের করার চেষ্টা করেছেন নবজাগরণের বৈজ্ঞানিক যুক্তিভিত্তিক ও আধুনিক চিন্তার আলোকে। “বিধবা বিবাহ” আইন প্রচলন, “বাল্যবিবাহ” রোধ সহ নানা সামাজিক বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেছেন। অপরদিকে এগুলি থেকে মানুষকে মুক্ত করতে হলে বৈজ্ঞানিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং আধুনিক শিক্ষার একান্ত প্রয়োজন তিনি তা উপলব্ধি করেছিলেন। সেযুগে দাঁড়িয়ে “সাংখ্য-বেদান্ত ভ্রান্ত দর্শন…” কথাটি তাঁর অন্তরের উপলব্ধি থেকেই ব্যক্ত করেছিলেন। আর তাই তিনি ছাত্রদের বার্কেলের ধর্মীয় দর্শন পড়ানোর থেকে যুক্তিবাদী মিলের লজিক পড়ানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। তিনি সামগ্রিক শিক্ষা বিস্তারে ইতিহাস, জীবনী, অ্যারিথমেটিক, জ্যামিতি, ফিজিওলজি, ভূগোল, প্রাকৃতিক দর্শন, নৈতিক দর্শন, পলিটিক্যাল ইকোনমি বিষয়গুলি পড়ানোর উপর জোর দেওয়ার কথা বলেছেন। সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাকে আবশ্যিক করেছিলেন।

শুধু Quantity education নয় Quality education এর উপর অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করতেন। তাঁর কথায়, “….একশত ছাত্রকে নিছক রিডিং ও অ্যারিথমেটিক শেখানোর চেয়ে সরকার যদি একজন ছাত্রকেও উপযুক্ত পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে, তবে জনগণকে প্রকৃত শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশি কাজ করা হবে।”   নারীশিক্ষা প্রবর্তন ও বিস্তারে তাঁর ভূমিকা অভাবনীয়। সেসময়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব দুর্গম হওয়া সত্ত্বেও নিজে মাইলের পর মাইল হেঁটে পালকিতে করে মেয়েদেরকে শিক্ষার আঙিনায় নিয়ে আসেন। লোকের দ্বারে দ্বারে গিয়ে চাঁদা তুলে স্কুল কলেজ স্থাপন করেন। নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য মাত্র ৭ মাসে ৩৫টি মহিলা বিদ্যালয় স্থাপন করেন যা আজও আমাদের কাছে অকল্পনীয়। সে সময়ে সমস্ত সামাজিক প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে এই কাজ যে কতটা কঠিন ছিল তা ব্যক্ত করা অসম্ভব। পড়াশোনার ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের যেকোনো ধরনের সমস্যায়, তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। তাঁর কষ্টার্জিত মাইনের প্রায় সবটাই খরচ হয়ে যেত ছাত্র-ছাত্রীদের কিংবা গরীব মানুষের সাহায্যার্থে অথবা স্কুল স্থাপনের কাজে। 

আমৃত্যু তিনি অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে বলিষ্ঠ থেকেছেন। কোথাও এতটুকু আপোষ করেননি। মর্যাদাহানিকর কিছু ঘটলেই তিনি স্থির থাকতে পারতেন না। সে কারণে নিজের চাকরি ছেড়ে দিতে, নিজের জামাইকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করতে কিংবা নিজের ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করতে দ্বিধা করেননি। গরীব সাধারন মানুষ ছিল তার প্রকৃত এবং পরম বন্ধু। তাদের প্রতি ছিল তাঁর অসীম ভালোবাসা ও মমত্ববোধ। ব্যক্তিগতভাবে বিদ্যাসাগর ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মত হাঁটুর উপর কাপড় পরতেন, তালতলার চটি পরতেন এবং টিকি রাখতেন মাথায়। আসলে এসবের মাধ্যমে তিনি এদেশের মানসিকতায় এদেশের রীতিকেই রক্ষা করতেন মাত্র। এটা তাঁর বাহ্যিক রূপ ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু অন্তরে, শিক্ষায়, ব্যক্তিত্বে বিদ্যাসাগর সেই যুগে একজন খাঁটি শিক্ষিত সাহেবের থেকেও ছিলেন আধুনিক। তিনি সর্বদা চেয়েছিলেন আধুনিক সমাজ গঠন করতে এবং সেই সমাজের উপযোগী নতুন মানুষ গড়ে তুলতে। সেই আহ্বান আজকের যুগে প্রযুক্তির এত উন্নতি সত্ত্বেও, তাঁর মৃত্যুর ১২৯ বছর (এ বছর তাঁর দ্বিশততম জন্মবর্ষ) পরেও আমাদের সমাজ তথা রাষ্ট্রের দিকে তাকালে বোঝা যায় সেই আকাঙ্ক্ষা কতটা প্রাসঙ্গিক! পরিশেষে তাঁর সেই আকুতি আজও আমাদের ভাবায়-  “এদেশ উদ্ধার হইতে বিলম্ব আছে। পুরাতন প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি বিশিষ্ট মানুষের চাষ উঠাইয়া দিয়া সাত পুরু মাটি তুলিয়া ফেলিয়া নূতন মানুষের চাষ করিতে পারিলে, তবে এদেশের ভাল হয়।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ten − 1 =