সিদ্ধার্থ বোস: রাজনীতি করেছেন, জেলখেটেছেন, রাস্তায় কাগজ ফেরি করেছেন, ফুটপাথে রাত্রিবাস করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, আজীবন মেসেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর পরিচয় তিনি সাহিত্যিক। শিবরাম চক্রবর্তী। শিশু সাহিত্যিক শিবরাম বাবু নিজেও সারাজীবন শিশুই থাকার চেষ্টা করেছিলেন। শিশুদের মতো থাকতেন, শিশুদের মতো করে খেতেন। প্রিয় খাবারটাও ছিল চকলেট কিংবা টফি লজেন্স। ৪০ তম মৃত্যু দিবসে শিবরাম বাবুকে শ্রদ্ধার্ঘ্য।
শিবরাম চক্রবর্তী, নামটা শুনলেই হাস্য রসের সাহিত্য গুলি মনে ভেসে ওঠে। শৈশবে শিবরাম বাবুর লেখা পড়েননি এমন বাঙালি হাতে গোনা যায়। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শিশুদের জন্য তিনি লিখে গিয়েছেন। অথচ সারাটা জীবন ভাগ্যান্বেষণেই কেটে গিয়েছে ওঁর। একসময় রাস্তায় রাস্তায় কলকাতার বিখ্যাত সংবাদপত্র 'বসুমতি পত্রিকা' বিলি করতেন। দুবেলা দুমুঠো অন্ন জোগার করতে এরপর সওদাগরী অফিসে কিছুদিন কাজও করেছিলেন নাম মাত্র বেতনের বিনিময়ে। বসুমতি'র সম্পাদক হেমন্তপ্রসাদ ঘোষের হাত ধরেই সাহিত্য জীবনে পদার্পন করেন শিবরাম। রস ও কৌতুকের শ্রেষ্ঠ লেখক শিবরাম চক্রবর্তী শুরু থেকেই চমক দিয়েছেন তাঁর সৃষ্টিতে। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে কিশোর জীবনের প্রেমের চিত্রও ধরা পড়েছিল। 'প্রেমের পথ ঘোরাল আজ এবং আগামীকাল', 'মেয়েদের মন', 'ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা' ইত্যাদিকে কখনওই বাঙালি ভুলতে পারবে না। ছোটদের জন্মদিনের উপহার হিসাবে প্রথমেই শিবরাম চক্রবর্তীর কথা মাথায় আসে।
মেসবাসী শিবরাম বিপদে পড়ে একবার কাবুলিওয়ালার থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন। নগদ ২টাকা সুদে ৫০ টাকা। সেই সময়ে এই টাকাই অনেক। প্রথম মাসের কিস্তি নিয়ে কোন বিড়ম্বনা হয়নি। কারণ ২ টাকা সুদ কেটে রেখেই কাবুলিওয়ালা তাকে ৪৮ টাকা দিয়েছিল। কিন্তু পরের মাস শেষ হতে গেলেও শিবরাম সুদের ২টাকা কোনও ভাবেই জোগার করতে পারেন না। শেষ পর্যন্ত কাবুলিওয়ালার তাগাদা থেকে মুক্তি পেতে মেস ছাড়া হলেন শিবরাম। আজ্ঞে হ্যাঁ, সেসময় কাবুলিওয়ালারা তাদের টাকা তুলতে এতটাই বদ্ধপরিকর ছিল, যে তারা কারোর কথাই ভাবত না। এক প্রকার গলায় পা দিয়ে তারা তাদের টাকা আদায় করত। সে যাইহোক, এরপর কিভাবে ঋণের টাকা শোধ করা যায়, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন শিবরাম। কিছুতেই কোনও উপায় বের করতে পারছিলেন না। ঠিক এই সময়েই বসুমতি'র সম্পাদক ওঁকে লেখালেখি শুরু করতে বললেন। প্রথমে কিছুটা দ্বিধাবোধ করলেও শেষে রাজী হয়ে যান শিবরাম। পরের দিন একটি লেখা নিয়ে সম্পাদকের কাছে গেলে সম্পাদক খুশি হয়ে লেখককে ৫টাকা দেন। আসলে সম্পাদক শিবরামকে উৎসাহ দিতে চেয়েছিলেন। ৫টাকা পেয়ে আনন্দিত শিবরাম গর্বের সঙ্গে কাবুলিওয়ালার কাছে গিয়ে তার ঋণ শোধ করে আসেন। এরপর আরও লিখতে থাকেন তিনি। কাবুলিওয়ালার ঋণ শোধ করে দেন, কিন্তু বাঙালিকে নিজের সৃষ্টির ঋণে ডুবিয়ে দিতে থাকেন শিবরাম।
বিয়ে করেননি শিবরাম, সংসার জীবনের বাঁধনে কোনও দিনও নিজেকে জড়াতে চাননি। ২৩৪ মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের একটি মেসেই সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন এই 'আজব' মানুষটি। শিবরাম চক্কোত্তি কথার ছলেই মানুষকে হাসাতেন। কখনওই কোনও খেদ ছিল না মানুষটির। ১৯৮০ সালের ২৮ আগস্ট, শিবরাম চক্রবর্তী পরলোক গমন করেন। তাঁর লেখা উপন্যাস গুলি হল, 'বাড়ি থেকে পালিয়ে', 'কলকাতার হালচাল', 'হাতির সঙ্গে হাতাহাতি', 'অকথিত কাহিনী', 'জীবনকেষ্টর জীবন-নাট্য', 'কৃতান্তের দন্তবিকাশ', 'বর্মার মামা', 'কে হত্যাকারী'।