কলকাতা: লকডাউনের জেরে প্রায় সাড়ে তিন মাস বন্ধ ছিল শহরের সমস্ত যাত্রীবাহী যানবাহন পরিষেবা। সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনও বাসই সেইসময় রাস্তায় নামতে পারেনি, অথচ রাস্তায় নামলে তবেই রোজগার হয় বাস মালিক তথা হেল্পার-মেকানিকদের। বর্তমানে আনলক পর্বে কিছু বাস ও মিনিবাস রাস্তায় নামলে সাময়িক ভাবে রেহাই পেয়েছে তাঁরা। যদিও আগের মতো রোজগার হচ্ছে না। ফলে আধপেটা খেয়েই সংসার চালাচ্ছে এই অভাবী মানুষগুলি।
তাঁদের কেউ বাসের ইঞ্জিন সারাই করেন, আবার কেউ গাড়িতে ইলেক্ট্রিকের কাজ করেন। আবার বাস চলাচলের ওপর নির্ভর করে গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন গ্যারেজ গুলিতে তাঁদের মধ্যে অনেকেই শ্রমিক বা হেল্পার হিসাবে কাজ করেন। শহরে এঁদের সংখ্যা হাজারেরও বেশি। করোনায় এঁদের প্রত্যেকের জীবন জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। হাওড়ার ফরশোর রোডের মঞ্জুল আলম, দীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে ইঞ্জিন মেকানিকের কাজ করেন। এই অঞ্চলে তাঁর নিজের গ্যারেজ আছে, আগে সেখানে দশ জনের বেশি শ্রমিক কাজ করতেন। প্রত্যেক শ্রমিককে মাসিক ৬ হাজার টাকা বেতন দিতেন মঞ্জুল। উপরি খোরাকি হিসাবে প্রতিদিন দিতেন আরও ১০০ টাকা। মঞ্জুলের কথায়, এপ্রিল মাসে কাজ না থাকাকালীনও শ্রমিকদের বেতন দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এখন আর পারছেন না। বর্তমানে একজন হেল্পারকে নিয়ে নিজেই কাজ করেন তিনি। কোনওমতে দিনে একটা গাড়ির কাজ জোটে মঞ্জুলের। ক্রমশ গলা ভারী হয়ে আসা মঞ্জুল জানায়, শ্রমিকদের বেশিরভাগই বাড়ি ফিরে গিয়ে এখন মাছ কিংবা সবজি বিক্রি করছে।
অন্যদিকে বাসের ইলেক্ট্রিক মেকানিক শেখ সাজ্জাদের অবস্থাও একই রকম দুর্দশাগ্রস্থ। গাড়ির সেল্ফ, ডায়নামো লাইট, ওয়্যারিংয়ের কাজ করেন তিনি। হাওড়ার আমতলা ফাঁড়ির কাছে তাঁর দোকানে আগে দম ফেলার সময় থাকত না। দিনে কমপক্ষে ১২০০ টাকার কাছাকাছি রোজগার হত। সেখানে বর্তমানে দিনে ৪০০ টাকাও রোজগার হচ্ছেনা সাজ্জাদের। তাঁর কথায় বর্তমানে বাচ্চাকে খাইয়ে সস্ত্রীক আধপেটা খেয়ে থাকছেন তিনি। অন্য কাজ কেন করছেন না জিজ্ঞাসা করায় সাজ্জাদ জানান, ছোটবেলা থেকে এই কাজই শিখে এসেছেন তিনি। অন্য কোনও কাজ করতে পারবেন না মন থেকে। মাছ কিংবা সবজি বিক্রি করতে সম্মানে বাধে। তাই হাজার কষ্ট করেও নিজের পেশাকে ধরে রেখেছেন সাজ্জাদ।
পাশাপাশি ঘাটালের টায়ার মিস্ত্রি মহম্মদ নঈম আনসারি নতুন টায়ার ভাড়া দিতেন। তিনি জানিয়েছেন, নতুন এক জোড়া বাসের টায়ারের আগে দাম ছিল ৪২ হাজার টাকা, করোনায় সব কিছুর দাম বাড়ায় এই টায়ারের দাম এখন ৪৬ হাজার টাকা। একটি বাসে ছ’টি টায়ার ও একটি স্টেপনির ভাড়া দিনে ৬০০ টাকা। আগে সেখানে দিনে ২০ থেকে ৩০ টি গাড়ি থেকে অনায়াসেই এই ভাড়া পাওয়া যেত। কিন্তু লকডাউনে বাস না চলায় এবং বর্তমানে চললেও আগের সংখ্যায় তা না হওয়ায় চরম আর্থিক সংকটে পড়েছেন আনসারি। আগে কিনে রাখা সমস্ত টায়ার পরে থেকে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ধার নিয়ে সেই সমস্ত টায়ার কিনেছিলেন, রোজগার নেই অথচ ঋণের দায়ে জেরবার বর্তমানে জেরবার আনসারি।