যান্ত্রিক উপায়ে ঘুচবে দুঃস্বপ্ন, আশার আলো দেখাচ্ছে গবেষণা

যান্ত্রিক উপায়ে ঘুচবে দুঃস্বপ্ন, আশার আলো দেখাচ্ছে গবেষণা

নয়াদিল্লি:  স্বপ্নের জগৎ একান্তভাবেই মানুষের নিজস্ব জগৎ, যা প্রকৃতি প্রদত্ত। কিন্তু হঠাৎ যদি জানতে পারেন যে আপনার সেই স্বপ্নের জগতটি যান্ত্রিক হয়ে গেছে। যেন টেলিভিশন বা মোবাইলের বিনোদন জগত। তাঁকে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে ইচ্ছেমত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে তবে সেই স্বপ্ন কি সত্যিই আর স্বপ্ন থাকবে নাকি দুঃস্বপ্ন মনে হবে? তবে এই নিয়ন্ত্রণের ফলে যদি আমাদের স্বপ্নগুলো আরও সুন্দর ও মূল্যবান হয়ে ওঠে তাতে ক্ষতি কি? এই বিশ্বে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। তাই একশো বছর আগেও এই স্বপ্নের জগতে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিলে, সালভাদোর ডালি থেকে টমাস এডিসনের মতো শিল্পীরা। তারা নিজেদের অনুপ্রেরণার জন্য স্বপ্নের জগতে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়েছিলেন একটি স্টিলের বলের মাধ্যমে।

পদ্ধতিটি কিছুটা এমন ছিল যে, কোনো ব্যাক্তি তন্দ্রা যাওয়ার সময় একটি স্টিলের বল হাতে শক্ত করে ধরে রাখবে। সে ঘুমিয়ে পড়ার পর তাঁরা বলটিকে হাত থেকে বের করে দেবে। বলটি মেঝেতে পড়ে যাওয়ার পর যে শব্দ হবে সেই আকস্মিক শব্দ থেকে স্বপ্নের অস্বচ্ছ একটা অবস্থা বোঝা যাবে যা তাদের সৃষ্টিশীল ভাবনার উৎস হবে।

ম্যাসাচুসেট ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি)র একদল বিজ্ঞানী এই 'স্টিল বল পদ্ধতি'র আধুনিকীকরণ করার প্রচেষ্টা করছেন ২১-শতকের জন্য। এক্ষেত্রে একটি ওপেন-সোর্স বায়োমেট্রিক যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। যা শব্দ আর গন্ধের একটি কৃত্রিম পর্দা বলা যায়। এর মাধ্যমে ঘুমন্ত মানুষের স্বপ্নগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। 'ডর্মিওর' নামের এই যন্ত্রটির লক্ষ্য হ'ল “হিপনোগজিক মাইক্রোড্রিম” বা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় সূক্ষ্ম স্বপ্নগুলোকে উৎসাহিত করা। এমআইটির বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে এটি চিকিৎসামূলক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে বা লোকের স্মৃতিশক্তি জোরদার করতে ব্যবহৃত হতে পারে।

নতুন এবং বাহ্যিকভাবে পরিধানযোগ্য এই যন্ত্রটি স্বপ্নকে বিভিন্ন উপায়ে ট্র্যাক এবং ইন্টারঅ্যাক্ট করে। যা এই ধারণাকেই বৈধতা দেয় যে স্বপ্নগুলি কেবল এলোমেলো মনের প্রকাশ নয়, বরং জ্ঞানের গভীর স্তরের দিকে প্রবেশ করে, ডর্মিওর-এর বৃহত্তর লক্ষ্য হলো, এর মাধ্যমে স্বপ্নগুলিকে অনুধাবন করা যায়, বাড়ানো যায়, কমানো যায়, ফলে জেগে থাকা অবস্থায় এর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

এমআইটির ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানী টেসা লাভ তৈরি করেছেন দুটি গম্বুজের আকৃতির ডোর্মিয়ন। তার একটিতে আছে নানারকম অডিও ক্লিপিং। এখানে নানান রকম শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। অন্যটিতে কৃত্রিম সুগন্ধী। এই গম্বুজের ভেতরে কোনো ব্যক্তি শুয়ে পড়লে কৃত্রিম প্রযুক্তির মাধ্যমে তাঁকে ধীরে ধীরে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া যায়। এরপর সেই মানুষটি চেতন আর অবচেতন জগতের মধ্যবর্তী হিপ্নোগগনিয়া স্তরে পৌঁছে গেলেই তাঁর উপর প্রয়োগ করা হয় অডিও ক্লিপিং বা কৃত্রিম সুগন্ধ। আর তার প্রভাব পড়বে ঘুমন্ত মানুষটির মস্তিষ্কে। সে শব্দ এবং গন্ধের মেলবন্ধনে পরিকল্পনা অনুযায়ী স্বপ্ন দেখানো যাবে তাঁকে।

জীবনের এক তৃতীয়াংশ ঘুমের জগতে কাটে, এইসময় আমাদের অবচেতন মন অজানা জায়গায় অবস্থান করে। আমরা স্বপ্ন দেখি, যদিও আমরা তার কারণ জানি না। যদিও এই রাত্রিকালীন চিত্র এবং কাহিনীসূত্রগুলি বহু প্রজন্ম ধরে কল্পনাশক্তি ধারণ করে আসছে। আধুনিক বিজ্ঞান মূলত বিশ্বাস করে যে দৈনন্দিন জীবনের উপর স্বপ্নের কোনও প্রভাব নেই। এমআইটি-র এক পিএইচডি- র ছাত্র এবং গবেষক অ্যাডাম হরউইচ 'ওয়ানজিরো'কে জানিয়েছেন যে, “স্বপ্ন হল মানুষের রাত্রিকালীন চিন্তা। যখন আমরা স্বপ্নের জগতে প্রবেশ করি সকালে সম্পূর্ন ভিন্ন অবস্থায় সেখান থেকে বেরিয়ে আসি। কিন্তু এর মূলে যে চিন্তা ভাবনা আছে বা তথ্যের পরিবর্তন সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কেউ জানতে চায়না।” তবে এই যন্ত্র সেই স্বপ্নগুলির মূল্যমান করবে।

তবে পুরো গবেষণা এখনও পরীক্ষামূলক এবং বাস্তবে এর ব্যবহার এখনও শুরু করা সম্ভব নয় বলেই জানিয়েছেন ল্যাবের এক গবেষক টেসা লাভ । তাঁর মতে এই ধরনের গবেষণার প্রযুক্তিগত দিকের পাশাপাশি  নৈতিক দিকটিও মাথায় রাখতে হবে। এই যন্ত্র মানসিক অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে সহায়ক হলেও সুস্থ মস্তিষ্ককে অসুস্থ করে তুলতে পারে। এছাড়াও ঘুমের স্বাভাবিকতার ওপর এর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ছে কিনা তাও পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। তবে সবশেষে বলাই যায় যে এই করোনা আবহে বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনে যে প্রভাব পড়েছে তাতে স্বভাবিক মানসিকতা ধরে রাখা বাস্তবিক অর্থেই কঠিন হয়ে পড়েছে। সেক্ষেত্রে মানসিক অবসাদ, আতঙ্ক, হতাশা প্রভৃতি সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আশাবাদীরা এই স্বপ্নযন্ত্রকে এখনই স্বাগত জানাতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × one =