মেদিনীপুর: আজ শুভেন্দু অধিকারীর গড়ে গিয়ে জনসভা করলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর এই জনসভা ঘিরে উত্তেজনার পারদ ছিল তুঙ্গে। তবে বাংলার রাজনৈতিক মহল যা ভেবেছিল, সেইরূপ কোনরকম বিতর্কের সৃষ্টি হল না, বরং এই জনসভা থেকে রাজ্যের সকল মানুষকে এক হবার বার্তা দিলেন শাসক দলের প্রধান। লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের স্লোগান হয়ে উঠেছিল, ‘৪২-এ ৪২’। ঠিক একই রকমভাবে এবার বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্লোগান, ‘২০২১ আমাদের। ২০২১ বাংলার’। একসময় যিনি বিরোধীদের শূন্য দেখতে চেয়েছিলেন, তিনি কী মহা গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রচারে কিছুটা সাবধানি? তৃণমূল কংগ্রেসের জয় ডঙ্কা বাজিয়েও মমতা বিরোধীদের স্বমূলে উৎখাতের হুমকি শোনালেন না। সম্প্রতি বাংলায় দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ‘র ভাষণে তৃণমূলকে বাংলা থেকে স্বমূল উৎখাতের কথা শোনা গিয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রুচি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন মমতা। শুভেন্দুর গড়ে দাঁড়িয়ে মমতা যেন একটু ব্যতিক্রমী। সংখ্যাকে দূরে সরিয়ে রাখলেন কারণ ‘৪২-এ ৪২’ তাকে সুখস্মৃতি দেয়নি। বিরোধীদের স্বমূল উৎখাতের কথাও বলেননি। শুধু বলেছেন, ২০২১ বাংলার। তবে বিজেপি কী বাংলার নয়। বহিরাগত …। শব্দ খরচ না করেই, সেই কথা বলে গিয়েছেন মমতা।
এদিন জনসভা থেকে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, দেশজুড়ে হিংসার রাজনীতি করেছে বিজেপি। টাকা ছড়াচ্ছে, দাঙ্গা লাগাচ্ছে, টাকা দিয়ে সরকার ফেলছে, সরকার গড়ছে। কিন্তু এইভাবে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারকে দমানো যাবে না বলে দাবি করেন তিনি। তাঁর কথায়, তৃণমূল কংগ্রেস দুর্বল দল নয়, এইভাবে ব্ল্যাকমেইল করে, রাজ্য থেকে তৃণমূল কংগ্রেসকে সরানো যাবে না। এক্ষেত্রে বিজেপির পাশাপাশি সিপিএম এবং কংগ্রেসকেও তুলোধনা করেন তিনি। মন্তব্য করেন, এখন বিজেপির সবথেকে বড় রক্ষক সিপিএম। এদিকে কংগ্রেস কখনো ব্যাঙের গালে কখনো সাপের গালেও চুমু খেয়ে তক্ষক হয়ে উঠেছে। অঙ্কা-বঙ্কা-সঙ্কা এই তিন দল বাংলা এবং দেশ চালানোর স্বপ্ন দেখে। এই স্বপ্ন কোনদিন পূরণ হবে না বলে দাবি করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই প্রেক্ষিতে কথা বলতে গিয়ে তিনি মনে করিয়ে দেন, যখন তৃণমূল কংগ্রেস প্রথম তৈরি হয়েছিল তখন অনেকে বলেছিল ছাগলে খেয়ে নেবে, গরু মাড়িয়ে দেবে। কিন্তু সকলের মনে রাখা দরকার, মাটিতে পেরেক পোঁতা যায়, কিন্তু পাথরে পেরেক পুঁততে গেলে তা ভেঙে যায়। একই সঙ্গে পিএম কেয়ারস ফান্ড সহ একাধিক ইস্যুতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে আক্রমণ করে সমালোচনায় বিদ্ধ করেন তিনি।
মমতা দাবি করেছেন, বিজেপি লুটেরাদের সুরক্ষা দেয়। আদতে বিজেপি হল, চুরি করে টাকা রাখার ব্যাংক! যারা টাকা লুট করেছে তারা বিজেপিতে নিজেদের টাকা জমা রাখছে, এই করে করেই একটার পর একটা সরকার ভাঙছে বিজেপি, এমনই দাবি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। একই সঙ্গে তিনি দাবি করেন, বিজেপির বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললেই তাকে জেলে ঢুকানোর ভয় দেখানো হচ্ছে। কিন্তু তিনি জেলে যেতে ভয় পান না বলে ঘোষণা করেন মমতা। মন্তব্য করেন, যেতে যেতে হলে যাবেন, সেখান থেকে লড়াই করবেন, কিন্তু টাকার জন্য বিজেপির সঙ্গে দোস্তি করবেন না, জনগণের সঙ্গে গাদ্দারি করবেন না। এই প্রেক্ষিতেই ২০২১ নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলার সাধারণ মানুষকে এক করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্লোগান তোলেন, ‘২০২১ বাংলার, ২০২১ আমাদের৷’
২০১৯ সালে শেষ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ১৮টি আসন জিতেছিল। ৪০.৬৪ শতাংশ ভোট তারা নিশ্চিত করেছে। যা ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের থেকে ২২.৭৬ শতাংশ বেশি। এই ব্যাপক ভোট বৃদ্ধি ইঙ্গিত করে কোনও কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষ বিজেপির দিকে ঝুঁকেছে। তা যে ধর্মীয় মেরুকরণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লোকসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে যদি বিধানসভায় বিজেপি, তৃণমূল, কংগ্রেস এবং বামদলগুলি ফলাফল বিচার করতে হয় তবে দেখা যাবে বিজেপি প্রায় ১২২টি আসনে এগিয়ে রয়েছে। ৪৩.৬৯ শতাংশ ভোট নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস ২২টি আসনে জিতেছিল। বিধানসভার ফলাফল বিচার করলে ১৬৩টি আসলে তৃণমূলের এগিয়ে। আপাতদৃষ্টিতে লোকসভার নিরিখে বিচার করলে বোঝা যায় তৃণমূল অন্তত ৪১টি আসনে এগিয়ে রয়েছে।
অঙ্ক বলছে মমতা ১৮টি আসনে হেরে গিয়েছেন তবে ভোটে হারেননি – ৪৩.৬৯ শতাংশ ভোট তাঁর দিকে ছিল। বিজেপি ৪০.৬৪ শতাংশ ভোট তাঁকে অবশ্য চিন্তায় রেখেছিল। কিন্তু, তা ছিল কোভিড এবং আমফান পূর্ববর্তী সময়। বাঙলার রাজনীতিতে কোভিড এবং আমফান বড় ভূমিকা গ্রহণ করেছে। শাসক দলের বিরুদ্ধে বড়সড় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। যদিও অতীতে নারদা বা সারদা কেলেঙ্কারির মত দূর্নীতির অভিযোগ রাজনৈতিক ভাবে তৃণমূলকে কোণঠাসা করলেও ভোটযন্ত্রে তার শূন্য প্রভাব পড়েছে। তা নিয়ে মমতা চিন্তিত হবেন, এমন কারণ নেই। কিন্তু, মেরুকরণের চাল মমতা ২০১৯ সালে বুঝে উঠতে পারেনি বলেই মনে হয়। ২০২১ এর আগে বাড়তি সতর্ক থাকবেন মমতা।