ওয়াশিংটন: করোনাা পরিবারের নতুন সদস্য সার্স কোভ-২ এইমুহুর্তে বিশ্বজুড়ে তার ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে। এই ভাইরাস প্রতিরোধের নির্দিষ্ট ওষুধ বা প্রতিষেধক নিয়ে এখনও পর্যন্ত বিশ্বের সমস্ত বিজ্ঞানীদের গবেষণাই সেই অর্থে কোনো দিশা দেখাতে ব্যর্থ। এর আগে ইবোলা, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং জিকার মতো ভাইরাসগুলিও মারাত্মক সংক্রামক হিসেবে শিরোনামে উঠে এসেছে। এমন আরও ভাইরাস আছে যা আগামী দিনে ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গবেষকরা। তাই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে করোনা আবহেই শুরু হয়ে গেছে সেইসব অজানা মারণ ভাইরাসগুলি অনুসন্ধানের কাজ। আর সেখান থেকেই উঠে আসছে নানান নতুন তথ্য। এখানে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধানের বিষয়টি হলো ভাইরাসের উৎপত্তি সংক্রান্ত তথ্যগুলি।
স্বভাবিকভাবেই এনিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও কৌতূহলের অন্ত নেই। এক্ষেত্রে আবার ব্যাক্টেরিয়া এবং ভাইরাস নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। ব্যাক্টেরিয়ার মত ভাইরাস জীবিত জীব নয় – গবেষকরা মূলত একে বস্তু বলেই মত পোষণ করেন। যদিও কিছু এক্ষেত্রে দ্বিমত আছে। কারণ ব্যক্টেরিয়ার মতন ভাইরাস নিজেরাই বংশবিস্তার করতে না পারলেও একটি পোষক কোষ বা হোস্ট সেলের আশ্রয় পেলে সেখানে নিজের বিন্যাস ঘটাতে পারে এবং সেই কোষগুলি বহুগুণ বৃদ্ধি করে রোগের সংক্রামণ ঘটায়। এদিকে সাম্প্রতি ব্রাজিলের সোডা লেক থেকে আবিষ্কৃত ৩০ হাজার বছর আগেকার দৈত্যাকার 'তুপানভাইরাস' গবেষকদের মূল ধারণাকে অনেকটাই প্রভাবিত করেছে। তুপানভাইরাস (দক্ষিণ আমেরিকান গুরানি গডের গন্ডার গডের নামকরণ করা) নিয়ে অধ্যয়নরত বিজ্ঞানীদের পাওয়া তথ্য অনুসারে এটি আমাদের দেখা এখনকার ভাইরাসের মতো নয়, নিজের দেখভালের দায়িত্ব নিজেই নিতে পারত অর্থাৎ নিজেই সম্পূর্ণ একটা যন্ত্র ছিল। সোডা লেকের মত লেকগুলির জল খুবই লবণাক্ত এবং উচ্চমত্রায় পিএইচ থাকে। যা কোটি কোটি বছর আগে পৃথিবীতে জলজ পরিবেশের পরিস্থিতি অনুকরণ করতে পারে।
আর এই ধরণের জল থেকে উদ্ভূত তুফান ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য গবেষকদের অবাক করে দিয়েছে। দেখা গেছে, অন্যান্য পরিচিত ভাইরাসের তুলনায় তুপন ভাইরাসে নেক বেশি প্রোটিন তৈরির যন্ত্রপাতি রয়েছে এবং এরা পোষক কোষের উপর নির্ভরশীল নয়। এই আবিষ্কারটি জটিল, মুক্ত-জীবন্ত কোষ থেকে ভাইরাসগুলির উৎপত্তি সম্পর্কিত তত্ত্বটি নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্র তৈরী করেছে। সাম্প্রতিক এই আবিষ্কারটি ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়েও নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
বিজ্ঞানীদের ভাইরাস সনাক্তকরণ এবং তাদের উৎস অধ্যয়ন করার উপায় হ'ল তাদের জিনগত উপাদানগুলি – প্রাণীদের টিস্যু এবং মাটিতে থাকা ডিএনএ বা আরএন-এর অণু। যদিও, ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান জীবাশ্মে পরিনত হওয়া উদ্ভিদের পাতাগুলিতে বা ঘাসে আটকে থাকা পোকামাকড়গুলির মধ্যে কখনও সনাক্ত করা যায়নি। ডাইনোসরদের মতো ভাইরাসের কোনও শারীরিক জীবাশ্মের প্রমাণ মেলেনি।
তবে, এতদিন যেখানে ভাইরাসগুলির উৎসের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা সীমাবদ্ধ ছিল, সাইবেরিয়ার ভূগর্ভস্থ চিরহিমায়িত অঞ্চলে কিছু প্রাচীন ভাইরাস সনাক্ত হওয়ার পর এখন নতুন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে আশা আলো দেখছেন গবেষকরা। বিগত বেশ কিছু বছর ধরে অব্যাহত গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জেরে হাজার বছর ধরে জমে থাকা বরফ ক্রমাগত গলতে শুরু করার ফলেই নতুন এই সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে।
ভাইরাসগুলির ডিএনএ ও আরএন-এর বিন্যাস সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে। যা এদের জেনেটিক কোডের পরিবর্তন করতে করতে এদের বেঁচে থাকার ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে। গবেষনায় দেখা গেছে ভাইরাসের নির্দিষ্ট একটিমাত্র কোনো উৎস হয়না । এদের একাধিক এবং বহু স্বাধীন উৎস আছে বলেই নিশ্চিত গবেষকরা। তাই এটা বলা যায়না যে একটি উৎস থেকেই ভাইরাস জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে নানান ধরনের ভাইরাস সৃষ্টি করেছে। বরং গবেষকদের মতে প্রতিটি ভাইরাস তাদের ভিন্ন পোষক কোষগুলির সঙ্গেই সহ বিকাশ লাভ করে।
উদাহরণস্বরূপ, হার্পিস একটি ভাইরাস যা মানুষকে সংক্রামিত করে তা সময়ের সাথে সাথে বিকশিত হয়, মানিয়ে নেয় যাতে এটি মানুষের কোষগুলিকে সংক্রামিত করার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে।
যদি আমরা বিবেচনা করি যে পৃথিবীতে সমস্ত জীবনের গঠন সমুদ্র থেকে শুরু হয়েছিল, তবে বিশ্বাস করা যুক্তিসঙ্গত যে সমুদ্রের মধ্যেই তারা তাদের পোষক বা হোস্টগুলির সাথে ভাইরাসগুলি বিকশিত হয়েছিল। এই প্রাণীগুলি স্থলভাগে স্থানান্তরিত হয়ে বিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে ভাইরাসগুলিও বিকশিত হয়েছিল এবং পৃথিবীর জীবকে সংক্রামিত করার ক্ষমতা অর্জন করে। এই বছরের শুরুর দিকেই, বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছিলেন যে কিছু ভাইরাস লক্ষ লক্ষ বছরের পুরানো হতে পারে এবং প্রথম মেরুদণ্ডী প্রানীর অস্তিত্বের সময় থেকেই এর অস্তিত্ব ছিল। তবে তাঁদের মতে এথেকে ভাইরাসগুলির উৎস ব্যাখ্যা করা যায় না।
তাই গবেষকদের মত-দ্বিমত সবমিলিয়ে ভাইরাসের উৎস নিয়ে কিন্তু এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি গবেষকরা। যা কিছু তথ্য উদঘাটন হয়েছে তার সবটাই মে গবেষনাধীন, এমনটাই দাবি খোদ গবেষকদের। যদিও বিশ্বজুড়ে করোনার তান্ডব ভাইরাস নিয়ে গবেষনায় নতুন করে যে তাগিদ ও উদ্যম তৈরী করেছে তাতে হয়তো ভাইরাসের উৎস সন্ধানেও দ্রুত সাফল্য আসবে এমনটা আশা করাই যায়।
(সূত্র- লাইভ সায়েন্স৷ দেখুন বিস্তারিত- https://theconversation.com/viruses-can-cause-global-pandemics-but-where-did-the-first-virus-come-from-94551?utm_source=whatsapp&utm_medium=bylinewhatsappbutton)