ওয়াশিংটন: করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে গবেষকদের পর্যবেক্ষণের ফলস্বরূপ বহু ক্ষেত্রে এই ভাইরাস সম্পর্কে দ্বিমত ও নানান পরস্পরবিরোধী তথ্য জনসাধারণের মধ্যে সত্যিই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। ইতিমধ্যেই করোনা রোধে 'তাপমাত্রা বৃদ্ধি' বা 'ন্যূনতম দূরত্ব' সংক্রান্ত দাবিগুলির মতো অধিকাংশই দুর্বল বলে প্রমানিত হয়েছে। এমনকি ভ্যাকসিন নিয়ে দাবিগুলিরও এপর্যন্ত কোনো নিশ্চিত ভূমিকা নিতে পারেনি।
“করোনা ভাইরাস নাকি দিন দিন শক্তি হারিয়ে দুর্বল হচ্ছে”। গত রবিবার ইতালির এক প্রবীণ চিকিৎসক আলবার্তো জাঙ্গরিলো এমনটাই দাবি করেন। এমনকি তিনি এও বলেন যে, বর্তমানে ক্লিনিক্যালি এই ভাইরাসটি ইতালিতে আর নেই। এক বা দু’মাস আগেও ইতালিতে যেভাবে তাণ্ডব চালিয়েছে এই ভাইরাস গত ১০ দিনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তার সেই ক্ষমতা নাকি অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।
মিলান শহরের সান রাফায়েলে হাসপাতালের শীর্ষস্থানীয় এই চিকিৎসকের মতামত স্বভাবতই ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। তবে এর ঠিক পরদিনই অর্থাৎ সোমবার বিশ্ববাসীকে আবারও হতাশ করল বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সাবধান বাণী৷
ইতালির চিকিৎসকের এই দাবির কোনোও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বলেই জানিয়ে দিলো হু-এর বিশেষজ্ঞ সহ অন্য একদল বিশেষজ্ঞ। রয়টার্স সূত্রে খবর, সোমবার এক সাংবাদিক বৈঠকে হু-এর মহামারীবিদ মারিয়া ভ্যান কেরখোভ সহ একাধিক বিশেষজ্ঞ এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ খারিজ করে দিয়ে জানিয়েছেন যে, সংক্রমণ বৃদ্ধি এবং রোগের ভয়াবহতা বৃদ্ধি ছাড়া এই ভাইরাসের আর কোনো দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
“সংক্রমণের দিক থেকে, ভয়াবহতার দিক থেকে এর কোনো পরিবর্তন হয়নি”, বলেই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ভ্যান কেরখোভ । তিনি আরও বলেছেন, “ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের পরিবর্তন এবং মানিয়ে নেওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। মহামারীটি এপর্যন্ত ৩৭০ হাজারেরও বেশি মৃত্যু এবং ৬ মিলিয়নেরও বেশি সংক্রমণ ঘটিয়েছে৷” লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিনের উদীয়মান সংক্রামক রোগের অধ্যাপক মার্টিন হিববার্ড বলেছেন, “সারস-কোভ -২ যা কোভিড-১৯ এর কারণ, সেই ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তনের পর্যবেক্ষন সংক্রান্ত গবেষণাগুলি এই ধারণাকে কখনোই সমর্থন করেনি যে এই ভাইরাস তার শক্তি হারাচ্ছে বা কোনওভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে৷”
তিনি ই-মেইল করে তাঁর মতামত জানিয়ে বলেছেন,“৩৫,০০০ এরও বেশি সম্পূর্ণ ভাইরাস জিনোমের গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে এপর্যন্ত এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে এর ভয়াবহতার ক্ষেত্রে কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে৷” সান র্গ্লাসগোর ইউনিভার্সিটি অফ ভাইরাস রিসার্চ সেন্টারের অস্কার ম্যাকলিনের মতে ভাইরাসগুলি দুর্বল হয়ে যাওয়ার পরামর্শগুলি “বৈজ্ঞানিক সাহিত্যের কোনও কিছুর দ্বারা সমর্থিত নয় এবং জিনগত ভিত্তিতেও তার অসম্ভব বলেই মনে হয়৷”
জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি, ওয়েক ফরেস্ট ব্যাপটিস্ট মেডিকেল সেন্টার, জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি এবং নর্থওয়েল হেলথের বিশেষজ্ঞ ও প্রতিনিধিদের মতেও করোন ভাইরাসের পরিবর্তনের কারণ সংক্রান্ত কোনো প্রমাণের বিষয়ে তাঁরা অবগত নন। জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরী বিভাগের চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক লিয়ানা ওয়েন বলেছেন, “কোনও প্রমাণ ছাড়াই ইতালির চিকিৎসকের এই মিথ্যা আশ্বাস দেওয়ার বিষয়টি সম্ভবত বিপজ্জনক। “করোনাভাইরাসের পরিবর্তন হয়েছে বলে কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। এটি একটি অত্যন্ত সংক্রমণযোগ্য এবং অত্যন্ত সংক্রামক রোগ। আমাদের আগের মতোই সতর্ক থাকতে হবে৷”
এদিকে জাঙ্গরিলো রয়টার্সকে বলেছেন: “আমরা কখনই বলিনি ভাইরাসটি পরিবর্তিত হয়েছে, আমরা বলেছি ভাইরাস এবং হোস্টের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া অবশ্যই পরিবর্তিত হয়েছে।” এর সপক্ষে তাঁর বক্তব্য,” এটি ভাইরাসের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারণে হতে পারে, যা তার মতে তাঁরা এখনও সনাক্ত করতে পারেননি বা সংক্রামিতদের মধ্যে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে৷” প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনির ব্যক্তিগত ডাক্তার হিসাবে ইতালিতে সুপরিচিত জাঙ্গরিলো যদিও জানিয়েছে, তাঁর সহকর্মী ম্যাসিমো ক্লেমেন্তি দ্বারা পরিচালিত একটি গবেষণার মাধ্যমে তার মন্তব্যের সমর্থন করা হয়েছে, যা আগামী সপ্তাহে প্রকাশিত হবে।