২০১০-২০২১: বিজেপির এক দশকের বিজয় রথ রুখতে পারবে বাংলা?

২০১০-২০২১: বিজেপির এক দশকের বিজয় রথ রুখতে পারবে বাংলা?

কলকাতা: ২০২০ পেরিয়ে একুশে পা দিতে না দিতেই বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেখা দিয়েছে চাপা উত্তেজনার আবহ। বিধানসভা নির্বাচনের এখনও চার পাঁচ মাস দেরি থাকলেও বাংলায় যে ভোটের দামামা বেজে গিয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বঙ্গ রাজনীতির বর্তমান আবহ কিন্তু ১০ বছর আগের এক বিধানসভা নির্বাচনকে মনে করাচ্ছে বারবার।

২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন বাংলায় ৩৪ বছরের বাম শাসনের সামনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামক চ্যালেঞ্জ খাড়া করেছিল। আজ ১০ বছর পরের নির্বাচনে সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলই বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। আর তৃণমূল কংগ্রেসের সেই চ্যালেঞ্জের নাম বিজেপি। গত কয়েক বছরে এ রাজ্যে ভারতীয় জনতা পার্টি যেভাবে শক্তি বৃদ্ধি করেছে তাতে বাংলার বাম সমর্থকদের একটা বড় অংশ গেরুয়া শিবিরের দিকে ঝুঁকেছেন বলেই মত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গের এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন যেন গত কয়েক বছরে গোটা দেশের রাজনীতির রদবদলকেও প্রতিফলিত করে। ভারতে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি এবং বিজেপির ক্রমবিকাশের ইতিহাসের দিকে চোখ রাখলে ৪টি মূল বিষয় সামনে আসে।

১. বিজেপির প্রত্যাবর্তনের যুগ (২০১১-২০২০) :  ২০০৪-এর নির্বাচনে পরাজয়ের পর ২০০৯ সালে লালকৃষ্ণ আদবানিকে প্রার্থী করে ভোটে দাঁড়িয়েছিল গেরুয়া শিবির। কিন্তু ভরাডুবি হয়েছিল তাতেও। ২০০৯,২০১০ এমনকি ২০১১ তেও বড় কোনো নির্বাচনী সাফল্য আসেনি বিজেপির ঝুলিতে। ২০১১ সালে আন্না হাজারের কার্যকলাপে বহুদিন পর কেন্দ্রে কংগ্রেসের জনপ্রিয়তায় ছেদ আসে। এদিকে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী পদে তৃতীয় বারের জন্য জয় পান নরেন্দ্র মোদী। মোড় ঘুরতে শুরু করে ভারতীয় রাজনীতির। এরপর ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি বিজেপিকে।

২. বামপন্থার বিপর্যয়: ২০১০ সালে ভারতে ৩টি রাজ্যের সরকারে পরিচালকের আসনে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি- পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা এবং ত্রিপুরা। কেরালা বাদে বাকি দুই বাম ডেরাতেই ২০১০ থেকে ক্রমশ পিছু হঠতে শুরু করে বামপন্থা। উভয় ক্ষেত্রেই দক্ষিণপন্থী রাজনীতির গ্রাস হয় তারা। পশ্চিমবঙ্গে ২০১৪ থেকেই বামেদের সমর্থনে ভাগ বসায় বিজেপি, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর ত্রিপুরায় ২০১৯ নির্বাচনে বামেদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় সেই বিজেপির সঙ্গে। ২০১৯-এর ভারতে বামপন্থার বিপর্যয় বহুদিন পর্যন্ত গভীর ক্ষত হয়ে থাকবে লাল শিবিরে।

৩. মুসলিম রাজনীতির পৃথকীকরণ:  গত ১০ বছরে ভারতে বিজেপির উত্থানের অন্যতম মূল ভিত হল মুসলিম রাজনীতির পৃথকীকরণ। ভারতের ১৩০ কোটি জনগণের প্রায় ১৪% মুসলমান। অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ, সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের মাধ্যমে মুসলিম প্রধান জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষাধিকার খন্ডন এবং সর্বোপরি তিন তালাক প্রথার নিবারণ ভারতের বর্তমান সরকারের তিনটি বড় পদক্ষেপ। এছাড়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কিংবা সাম্প্রতিকতম লাভ জিহাদ বিরোধী আইন ভারতের হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের অন্যতম কান্ডারি। এক্ষেত্রে গেরুয়া শিবিরের তরফে ভোটে মুসলমান প্রার্থীরা সংখ্যা হ্রাসও উল্লেখের দাবি রাখে।

৪. হিন্দুত্বের দুর্গে টিকে থাকাই তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক বিকল্পের সামনে এখন মূল চ্যালেঞ্জ: ১৯৯০ কিংবা ২০০০ এর দশকের অধিকাংশ সময় ভারতে কংগ্রেস কিংবা বিজেপির শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু তারা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর উপরেও ছিল নির্ভরশীল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় রাজনীতিতে বামপন্থার অবনমনের পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদের উত্থানও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই বিষয়টি সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়েছিল। উত্তরপ্রদেশ সহ অন্যান্য অনেক রাজ্যেই বিজেপির সাফল্য এসেছে রাজনীতিকে ধর্মের রঙে রাঙিয়ে। বিজেপির এই সাফল্যের ধারাকে কি রুখতে পারবে বাংলা তথা তৃণমূল? নাকি দেশের বাকি রাজ্যগুলির মতো বঙ্গেও উড়বে গেরুয়া পতাকা? একুশের শুরুতে রাজ্য রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন সেটাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thirteen − nine =