নারদের খেলায় গারদে ৪, কোন অঙ্কে চাল গেরুয়ার?

নারদের খেলায় গারদে ৪, কোন অঙ্কে চাল গেরুয়ার?

 

বিবস্বান বসু:  কার্যত লকডাউনের বাংলায় সোমবার সকাল থেকেই নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহের শুরু৷ চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্স রাতে৷ গ্রেপ্তার, জামিন, জামিনে স্থগিতাদেশ, অতঃপর ঠিকানা প্রেসিডেন্সি জেল৷ টানটান উত্তেজনায় দিনভর পটপরিবর্তন৷ কেন্দ্রীয় বাহিনীর ঘেরাটোপে চেতলার বাড়ি থেকে ফিরহাদ হাকিমকে সিবিআইয়ের আটক করা দিয়ে সূত্রপাত৷ সেখান থেকে সোজা নিজাম প্যালেস৷ এর মধ্যেই খবর, সেখানে ইতিমধ্যেই হাজির সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মদন মিত্র ও শোভন চট্টোপাধ্যায়৷ আটক নাকি গ্রেপ্তার- এই নিয়ে খানিক দড়ি টানাটানির পর সিবিআইয়ের বিবৃতি, রাজ্যপালের অনুমতিসাপেক্ষে গ্রেপ্তার তৃণমূল কংগ্রেসের তিন নেতা-মন্ত্রী সুব্রত, ফিরহাদ ও মদন এবং প্রাক্তন মন্ত্রী তথা মেয়র শোভন৷ তার আগেই অবশ্য তাঁকে গ্রেপ্তারের দাবি নিয়ে নিজাম প্যালেসে ধরনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বাইরে তখন কেন্দ্রীয় বাহিনী আর তৃণমূলের অগুনতি কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে তুলকালাম পরিস্থিতি, রাজভবনে বিক্ষোভ, জেলায় জেলায় প্রতিবাদ- সব মিলিয়ে বোঝারই উপায় নেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলায় রাজ্য এখন রয়েছে বিধি-নিষেধের আওতায়!

বিশেষ সিবিআই আদালতে ভার্চুয়াল শুনানি আর দিনভর টানাপোড়েনের শেষে ব্রেকিং নিউজ- প্রভাবশালী তত্ত্ব খারিজ, অন্তর্বর্তী জামিনে মুক্ত অভিযুক্ত চতুষ্টয়৷ তখনও কে জানত, এখন অপেক্ষা করে রয়েছে চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্স৷ প্রথম রাউন্ডে মুখ পোড়া সিবিআই জামিনের বিরোধিতা করে এদিনই হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির দ্বারস্থ হলে, রাতেই উধাও তৃণমূলের স্বস্তি৷ আর বিজেপি? রাজনৈতিক মহল বলছে, যতই ‘আইন আইনের পথে চলুক’ ২ মে’র পর ১৭ মে- ১৫ দিনের ব্যবধানে প্রথমে ভেস্তেই গিয়েছিল পদ্মের খেলা৷ কিন্তু ম্যাচ ঘুরেছে এক্সট্রা টাইমে৷ যদিও পিকচার আভি বাকি হ্যায়, তবে আপাতত গেরুয়ার ঘরে হাসি। কিন্তু সে তো সারাদিনের আইনি নির্যাস, দিনভর সবচেয়ে বড় হয়ে উঠল যে প্রশ্নটা, সদ্যই যেখানে বিপুল জনাদেশ নিয়ে ফের নবান্নের মসনদে আসীন হয়েছেন মমতা, এই সংকটের সময়ে অতিমারির মোকাবিলাই যেখানে অগ্রাধিকার, সেখানে কেন এখন এই সিবিআই তৎপরতা? একি নিছকই প্রতিহিংসার রাজনীতি, হারের শোধ তোলা নাকি বঙ্গেও শুরু করে দেওয়া ‘অপারেশন লোটাস’?

সিবিআইয়ের সক্রিয়তার সময়কাল নিয়ে প্রশ্ন অনেক দিন ধরেই৷ ২০১৪ সালের ঘটনা, অভিযোগ সামনে আসে দু’বছর পর৷ তার পর ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও, পরিস্থিতি অনুযায়ী ঝুলি থেকে বেড়াল বের হয় মাঝে-মধ্যে৷ নইলে বাকি সময়টা সারদার মতো নারদ তদন্তও শীতঘুমে৷ অভিযোগ-বিচার সব কিছু তার নিজস্ব ধারায় হবে ঠিকই, কিন্তু সুব্রত-ফিরহাদ-মদন-শোভনদের গ্রেপ্তারির ক্ষেত্রেও প্রশ্নে সেই সময়৷ ভোটের আগে হলেও কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে ব্যবহার করে প্রতিহিংসার রাজনীতি করার চিরাচরিত অভিযোগ উঠত, হিতে বিপরীত হবে কি না তা নিয়ে বিশ্লেষণ হত চুলচেরা, তবু না-হয় বোঝা যেত লক্ষ্য বাংলা দখল৷ কিন্তু কেন এখন? তা হলে কি ভোটে ভরাডুবির আক্রোশ মেটাতে আবার নামিয়ে দেওয়া এজেন্সিকে? নাকি অন্য রাজ্যের মতো বাংলাতেও পিছনের দরজা দিয়ে ঘুরপথে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা? তবে সংখ্যার বিচারে ‘অপারেশন লোটাস’ বাংলায় যে সফল হওয়া সম্ভব নয়, তা যে মোদি-শাহরা বোঝেন না, তা নয়৷ তবে কি এবার না-হলেও পরের বারের খেলা শুরু করে দেওয়া? ভোট পরবর্তী হিংসার অভিযোগকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় দল পাঠানোই হোক বা রাজ্যপালের মাঠে নেমে পড়া, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গদিতে ফেরার শুরুর দিন থেকেই রাজ্য সরকারের ওপর চাপ বাড়ানো আরম্ভ হয়ে গিয়েছে৷ প্রথমসারির নেতা-মন্ত্রীদের সিবিআইয়ের জালে তোলা কি সেই চাপবৃদ্ধিকে লাগাতার করারই কৌশল? নইলে ৫ বছরের পুরনো মামলা এখন নতুন করে খুঁচিয়ে তুলে, অতিমারির সময়ে এভাবে ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা করে, রাজনীতির ময়দান তাতিয়ে দেওয়ার নেপথ্য কারণ কী? করোনা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যর্থতাকে আড়াল করতে অভিমুখ ঘোরানোর ছক নাকি বাংলার রায়ের প্রেক্ষিতে ’২৪-এর দিল্লি দখলের লড়াইতেও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জার হয়ে ওঠা মমতাকে অঙ্কুরেই দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা?

তবে গোটা দিনের মেগা শোয়ে সবচেয়ে বেশি টিআরপি তুলেছে একটাই প্রশ্ন- এই ভাবে চাপ বাড়িয়ে কেন্দ্র কি বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসনের পথ তৈরি করছে? একে তো ভোট পরবর্তী হিংসা, তার ওপর এদিনের গ্রেপ্তারিকে কেন্দ্র করে রাজ্যপালের সুপারিশে ভর করে আইন-শৃঙ্খলার অবনতির অভিযোগে ৩৫৬ ধারার রাস্তা সুগম করছে তারা? তবে একেই রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা নিছক মুখের কথা নয়, তার ওপর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত সরকারকে এভাবে বিড়ম্বনায় ফেলে লাভের গুড় ঘরে তোলা যে নেহাতই কষ্টকল্পনা, এব্যাপারেও সম্যক ওয়াকিবহাল গেরুয়া নেতৃত্ব। নইলে অনেক আগেই দাবি-দাওয়ায় কান দিয়ে ৩৫৬ ধারা জারি করে তৃণমূল নেত্রীকে ‘শহিদ’ হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার মতো ভুলটা তাঁরা করতেন। তখনও যখন করেননি, তখন এখনও করবেন বলে মনে হয় না। তা হলে, ঘুরে-ফিরে একই প্রশ্ন, এখন কেন গ্রেপ্তারি? চার্জশিট পেশের সময়টা নেহাতই কাকতালীয় নাকি অন্য কোনও সমীকরণ? নিজেদের ঘরেই যেখানে মজুত শুভেন্দু-মুকুল-শঙ্কু, সেখানে কোন অঙ্কে এমন ঝুঁকি বিজেপির? তবে কি মমতাকে প্যাঁচে ফেলতে শুভেন্দু-মুকুলকেও বলি দিতে তৈরি মোদি-শাহরা? নেপথ্যের চাল যাই হোক না কেন, তা আটকে থাকবে নিছক জল্পনার বৃত্তেই। তবে সোম-রাতে যেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, গোড়ায় ধাক্কা খেলেও এখন শাসকের ঘুঁটি মজবুত৷ অপেক্ষা এখন পরবর্তী শুনানির। ‘খাঁচার তোতা’ নাকি তৃণমূল, পরের রাউন্ডে ভাগ্যদেবী কোন ঘরে পা ফেলে, উত্তর মিলবে বুধে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × three =