কেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে গোটা বিশ্ব?

কেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে গোটা বিশ্ব?

 তপন মল্লিক চৌধুরী : আমেরিকার ৪৬ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নানা দিক থেকেই তাৎপর্যময়। ২০১৬-র নির্বাচনে যেখানে মোট ১৩৬.৫ মিলিয়ন বা ১৩ কোটি ৬৫ লাখ ভোট পড়েছিল সেখানে কোভিড-১৯ সংক্রমণের সময় ভোট পড়েছে তার থেকে অনেক বেশি। সেদিক থেকে একটি কথা বলা যায় যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনা ভাইরাসের সংক্রমণকে সামাল দিতে পারেন নি। প্রায় সবকটি জনমত সমীক্ষায় এগিয়ে ছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বিডেন। যদিও ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে হওয়া সবকটি সমিক্ষায় জিতে গিয়েছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন, কিন্তু কার্যত সব সমীক্ষা জনমত আর রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতামতকে ভুল প্রমাণ করে শেষ পর্যন্ত রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পই জয় পেয়েছিলেন। প্রসঙ্গত; আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে। যে পদ্ধতির প্রবর্তন হয়েছিল প্রাচীন দাসত্ব ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্য।

এবারের নির্বাচনের সবচেয়ে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তাহল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হিসেবে জো বিডেন সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। তাঁর ঝুলিতে ইতিমধ্যেই ৬ কোটি ৯১ লাখ ৬৫ হাজার ৯৫৫টি ভোট পড়েছে। সংখ্যাটা সম্পূর্ণ ফল প্রকাশে আরও বেড়ে যাবে। তিনি বারাক ওবামার পাওয়া ৬ কোটি ৯৪ লাখ ৯৮ হাজার ৫১৬ ভোটের রেকর্ড ভেঙে দিতে পারেন। অন্যদিকে ১৯০৮ সালের পর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি অংশ নিয়েছে। ওই বছর মোট ভোটারের ৬৫ শতাংশ ভোট দিয়েছিল। এবার ভোট দিয়েছে ৬৭ শতাংশ ভোটার।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বহু আগে থেকেই দুনিয়া জুড়ে আগ্রহ তৈরি হয় কে হবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। এবারও সেই আগ্রহ সব থেকে বেশি ছিল ট্রাম্প বিরোধী দেশগুলির। সেই তালিকায় প্রথমেই আছে চীন, এছাড়াওইরান, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়ার মতো দেশগুলি। কারণ হোয়াইট হাউজের কুর্সিতে কে বসছেন তাকে ভেবেই বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশকে নতুন করে ভাবনা চিন্তা শুরু করতে হয়।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে যেমন আর্মেনিয়ান-আজারবাইজানের মধ্যে যুদ্ধে মধ্যস্থতা, সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে সমর্থন ইত্যাদি নিয়ে পুতিনকে আগে থেকেই ভাবতে হচ্ছে।কারণ তিনি আগে থেকেই বেশ চাপের মধ্যে রয়েছেন। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিরোধীদের উত্থান, বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনিকে বিষ প্রয়োগ ইত্যাদি ইস্যুগুলি রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে করোনার অর্থনৈতিক বিপর্যয়। ২০১৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ের বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারেরজোরালো অভিযোগ উঠেছিল। এবার তা নেঈ ঠিকই কিন্তু হোয়াইট হাউজে যিনিই আসুন না কেন, পুতিনকে পরবর্তী চার বছর ক্ষমতার খাতিরেই তার বিরুদ্ধে  লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

উত্তর কোরিয়ারকিম জং-উনের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনেক মিল। ট্রাম্প যেমন আনপ্রেডিক্টেবল, মাঝেমধ্যে চমকে দিতে তিনি বেশ পছন্দ করেন, তাছাড়া তিনি যে কখন কী বলবেন, কী করবেন তা আগে থেকে কেউ অনুমান করতে পারেন না। উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং-উনের বেলায়ও একই কথা বলা যায়।হয়ত এসব কারণেই ট্রাম্পের সঙ্গে উনেরএকটা সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। অবিশ্বাস ফিরিয়ে আমেরিকার প্রতি বিশ্বাস, এছাড়াও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ট্রাম্প সহজ সম্পর্ক তৈরি করা ট্রাম্পের একটা বড় সাফল্য।কিন্তু ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরে এলে ওই সম্পর্ক ধরে রাখা সহজ হত না। অন্যদিকে বিডেন ক্ষমতায় এলে সম্পর্কের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হত। তবে আমেরিকারপ্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নিয়েপিয়ংইয়ংয়ের আগ্রহ যথেষ্ট। কারণ ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়ে কিম জং-উন কিভাবে এগোবেন বা পিছোবেন তা দুজনের ক্ষেত্রে এক ভাবনা নয়।

ইরানট্রাম্পের সময় বেশ চাপেই ছিল। পারমাণবিক চুক্তি থেকে ওয়াশিংটনের নাম তুলে নেওয়া ও আমেরিকার নিষেধাজ্ঞায় ইরানের অর্থনীতি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  সেদিক থেকে ট্রাম্প ফিরে না এলে তেহরান যথেষ্ট খুশি হবে। কারণ তেহরানের বিশ্বাস বিডেনের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটালে পারমাণবিক চুক্তি আবার আগের মতো অবস্থায় ফিরবে, যাতে করোনা-পরবর্তী বিশ্বে ইরানের অর্থনীতিক কিছুটা হলেও আগের মতো অবস্থায় ফিরিতে পারবে। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইসরায়েল ভীতি কমিয়ে আনতে ট্রাম্পের তুলনায় বিডেন অনেক বেশি কার্যকর বিকল্প। যে কারণে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিল ইরান।

ডোনাল্ড ট্রাম্প চিনকে গোড়া থেকেই পয়লা নম্বর শত্রু ভেবে এসেছিল। ওয়াশিংটন আর বেজিংয়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিরোধ গোটা দুনিয়াকে বিশ্বকে বলা যায় দুই মেরুতে ভাগ করে ফেলেছিল। এই মুহূর্তে দু’দেশের সম্পর্কের প্রধান প্রতিবন্ধকযে বাণিজ্যযুদ্ধ তা ট্রাম্পের জমানায় শুরু হয়েছিল। এছাড়াজল ও স্থলে ভূরাজনৈতিক বিরোধ তো আছেই। প্রতিযোগিতা আছে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তি খাত থেকে শুরু করে আরও বহু বিষয়ে। এসব কারণে আমেরিকার প্রেসিডেন্টনির্বাচন ঘিরে তীব্র আগ্রহ বেজিংয়ের। ট্রাম্প দ্বিতীয় ক্ষমতায় ফিরে আসা মানে চিনের বিরুদ্ধে আরো আগ্রাসী নীতি গ্রহণ। অন্যদিকে বিডেন চিন নিয়ে কিছুটা নমনীয় হবেন বলেই আশা।তবে এখনও পর্যন্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে কোনও মন্তব্য কিংবা প্রতিক্রিয়া জানায় নি চিন, রাশিয়া, ইরান। এখনও পর্যন্ত চুপ থাকাটাই যেন সবচেয়ে নিরাপদ কূটনীতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eight − 3 =