‘স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড’ প্রমাণ করল উচ্চশিক্ষা এখন কর্পোরেটদের খপ্পরে বিরাট এক মহার্ঘ পণ্য!

‘স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড’ প্রমাণ করল উচ্চশিক্ষা এখন কর্পোরেটদের খপ্পরে বিরাট এক মহার্ঘ পণ্য!

কিংকর অধিকারী: রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটের আগের প্রতিশ্রুতি মত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ‘স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড’ চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বলা হয়েছে ছাত্র-ছাত্রীরা উচ্চশিক্ষার জন্য ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থ ব্যাংক থেকে এই কার্ডের মাধ্যমে ঋণ হিসেবে নিতে পারবে। সুদের হার ৪%। ঋণশোধ করবার জন্য সর্বোচ্চ ১৫ বছর সময় দেওয়া হবে। এরমধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে ঋণ শোধ করতে হবে। রাজ্য সরকার গ্যারান্টার হিসাবে থাকবে। অনেকে এই স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে একটা আশার আলো দেখতে পেয়েছেন। বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থায় অর্থ ছাড়া এক পা এগোনো অসম্ভব। বহু ছাত্র-ছাত্রী অর্থের অভাবে মেধা থাকা সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষায় পৌঁছাতে পারে না। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয় মাঝপথে পড়াশুনা ছেড়ে দিতে। প্রকৃত মেধার অপমৃত্যু ঘটে। আগামী দিনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে এই সুযোগ ছাত্র ছাত্রীর ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করবে বলে অনেকে মনে করছেন।

এবারে বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখা যাক। মধ্যবিত্তদের একটা অংশের লক্ষ লক্ষ টাকা ঋণ গ্রহণ এবং পরিশোধ করার ক্ষমতা রয়েছে। তাঁরা ঋণ গ্রহণ করে তাঁদের সন্তানদের পড়ানোর জন্য এক্ষেত্রে একটা বড় সুযোগ পাবেন – একথা অস্বীকার করা যাবেনা। কিন্তু যাঁরা অত্যন্ত দরিদ্র, আর্থিক দিক দিয়ে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ তাঁরা তাঁদের সন্তানের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ঋণ নেওয়ার সাহস করবেন তো? কেননা, সন্তানকে পড়ানোর পর নিশ্চিত চাকরির সুযোগ যে পাওয়া যাবে তার গ্যারান্টি কোথায়? এমনকি, যে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মানুষ নিজের সঞ্চিত অর্থ এবং স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড থেকে প্রাপ্ত অর্থ একসাথে কাজে লাগিয়ে বিরাট কোন একটা আশায় সন্তানকে পড়াবেন সেক্ষেত্রেও কি সুনিশ্চিত গ্যারান্টি রয়েছে? স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের সাফল্য দাঁড়িয়ে রয়েছে এই জায়গায়।

আসলে আমাদের বুঝতে হবে বর্তমানে চাকরির বাজারটা কোথায়? বহু ধরনের ডিগ্রি নিয়ে বছর বছর লক্ষ লক্ষ ছাত্র ছাত্রী পাস করে বসে রয়েছে। চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি তো দূরের কথা ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে। সেখানে স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা ঋণ করার সুযোগ হয়তো পেয়ে গেলাম কিন্তু চাকরি পাওয়ার দরজাটা যদি প্রায় বন্ধই থাকে তাহলে এক কথায় আমরা সবাই ঋণী হয়েই থেকে যাব। আজও যেভাবে চাকরীর পরিসর সংকুচিত হচ্ছে, একইভাবে আগামী দিনেও সেই সংকটের হাত থেকে মুক্তির উপায় রয়েছে বলে মনে হয় না। তাহলে আজ আমরা যারা স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের এই সুযোগটাকে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো করে ভাবছি তাঁরা কি ভবিষ্যৎটা ভালো করে উপলব্ধি করতে পেরেছি? অগাধ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে যখন ভবিষ্যৎটা অন্ধকার হয়ে দাঁড়াবে তখন এই আনন্দের জায়গাটা থাকবে তো?

ঋণ পাওয়ার সুযোগের সঙ্গে চাকরি বা কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা রয়েছে কি?  সমস্ত ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ঢালাও লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। হাই টেকনোলজির যুগে যন্ত্রনির্ভর শিল্পে ম্যান পাওয়ার কমছে। মুনাফা আরো মুনাফা বৃদ্ধি একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি চাকরির সুযোগ ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে। পাঁচ, দশ, বিশ হাজার টাকা দিয়ে বেকারদের শ্রম লুটে নেওয়া হচ্ছে। ব্যক্তিমালিকদের মুনাফার পাহাড় তৈরির সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে পড়াশোনার পর যদি কর্মসংস্থান নিশ্চিত হত তাহলে নিশ্চয়ই তা বেকারদের জীবনে আশীর্বাদ স্বরূপ হত কিন্তু সাধারণ বাড়ির সন্তানরা যখন বিরাট একটা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে অন্ধকার ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে তখন সেই জীবন যন্ত্রণার হাত থেকে কে রক্ষা করবে?

তাছাড়া ব্যাংকে গিয়ে ঋণ গ্রহণ যতটা সহজ মনে হচ্ছে বাস্তবে তা কি সম্ভব হবে? এমনিতেই অনেক নিয়ম থাকা সত্ত্বেও একটা সাধারন মানুষকে ব্যাংক ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বহু ধরনের শর্ত আরোপ করা হয়ে থাকে। এখানে বলা হয়েছে রাজ্য সরকার গ্যারেন্টার থাকবে। তা সত্ত্বেও প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতেই তার উত্তর পাওয়া যাবে।

এমনিতেই কি কেন্দ্র, কি রাজ্য সরকার গুলির বদান্যতায় শিক্ষার ব্যবসায়ীরা শিক্ষার সমস্ত ক্ষেত্রে লুটের পসরা সাজিয়ে রেখেছে। হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ, এমনকি কোটি টাকার বিনিময়ে ডিগ্রী কেনার সুযোগ করে দিয়েছে। এখন যার অর্থ নেই, তার শিক্ষার ডিগ্রী পাওয়ার অধিকার নাই। শিক্ষা ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিকভাবেই এই স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের ঘোষণায় যারপরনাই আহ্লাদিত। তারা শ্যোন দৃষ্টি নিয়ে তৈরি রয়েছে সরকারি মদতে এই ধরনের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে সব কিছু লুটে নিতে। ধনকুবের গোষ্ঠী আরো বেশি করে মুনাফা পাহাড় তৈরি করবে। নিঃশেষিত হবে আশায় বুক বাঁধা অতি সাধারণ অথবা মধ্যবিত্ত পরিবার পরিজনরা। যে সমাজে চাকরি নেই, কর্মসংস্থান নেই সেখানে লক্ষ লক্ষ টাকা ঋণ দিয়ে শিক্ষার ডিগ্রি কেনার প্রলোভন কোন্ সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে অসংখ্য বেকারদের? বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে সবাই সফল হবে তার গ্যারেন্টি কোথায়? সবার ক্ষমতা কোথায় শোধ দেওয়ার? তখন কী হবে? গরীব বাড়ির সন্তানরা ঋণ নিতে সাহস পাবে তো? ১৫ বছরের মধ্যে সুদে-আসলে ঋণের অর্থ ফিরিয়ে দিতে পারবেন তো? না পারলে সরকারগুলো দেদার হস্তে সমস্ত ঋণ মুকুব করে দেবে বলে মনে হচ্ছে? এখনই সরকারের ঘাড়ে সাড়ে চার লক্ষ কোটি ঋনের বোঝা! এরপর এই বিপুল পরিমাণ ঋনের দায় নেবে তো? তাহলে সরকার এখনই বলে দিক না, যারা শিক্ষা শেষে সম্মানজনক অর্থের বিনিময়ে কর্মে নিয়োজিত হতে পারবে না তাদের ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের কোন প্রয়োজন নেই। তা কিন্তু বলছে না সরকার। এর ফলে বেকারদের জীবন অনিশ্চিত হলেও শিক্ষা ব্যবসায়ীদের মুনাফার পাহাড় আরো বিরাট আকার ধারণ করতে চলেছে তা নিশ্চিত করে বলে দেওয়া যায়।

সত্যিই যদি বেকারদের প্রতি দরদবোধ থেকে সরকারগুলো কিছু ভাবতো তাহলে সবার প্রথম যে কাজটি করতে হতো সেটা হল, শিক্ষার সম্পূর্ণ সুযোগ সবার ক্ষেত্রে সমান করে দেওয়া। উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত দেশের প্রতিটি নাগরিক সুলভে জ্ঞান জগতে প্রবেশ করার সুযোগ পেত। শিক্ষা সকলের কাছে সুলভ এবং উন্মুক্ত হত। জ্ঞান জগতে সবার সমান বিচরণের সুযোগ করে দিতে হত। এখানে কোন অর্থের বেড়াজাল দিয়ে সাধারণের প্রবেশ আটকে দেওয়া চলবে না। মহাত্মা গান্ধীর কথায়, -“সূর্য যেমন সকলকে সমানভাবে কিরণ দেয় এবং বৃষ্টির ধারা যেমন সবার জন্যই ঝরে পড়ে,শিক্ষাও তেমনি সকলের জন্য সহজলভ্য হবে।”

স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও শিক্ষার সুযোগ যতোটুকু ছিল ক্রমাগত আরো তা সংকুচিত হচ্ছে। শিক্ষা যে আজ কর্পোরেটের খপ্পরে, সাধারণের নাগালের বাইরে বিরাট মহার্ঘ পণ্যে পরিণত হয়েছে তা প্রমান করে দিল এই স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড। সরকার এক প্রকার প্রকাশ্যে বলেই দিল লক্ষ লক্ষ টাকা ছাড়া উচ্চশিক্ষায় তোমার প্রবেশাধিকার নেই! শিক্ষা ব্যবসায়ীরা লকলকে জিভ নিয়ে আরো বেশি লুটের জন্য অপেক্ষায়!

স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড কারো কারো ক্ষেত্রে লটারির মতো হয়তো সাফল্য এনে দেবে ঠিক কিন্তু বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীর কাছে এটি একটি মাকড়সার জাল!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fourteen − seven =