মালদা: ইংরেজ আমল। রতুয়ায় সেই সময় জমিদারি ছিল হরিমোহন মিশ্রের। দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্যক্তিত্ব। হরিশ্চন্দ্রপুরের বাসিন্দা হলেও জমিদারি দেখাশোনার জন্য তিনি রতুয়ার কাহালা এলাকাতেই থাকতেন। হরিমোহনবাবুর ছিল আম-লিচুর প্রবল শখ।
পারিবারিক সূত্রে জানা যাচ্ছে, আমের গন্ধ ছাড়া রাতে তিনি ঘুমোতে পারতেন না। তাই দেশ, এমনকি বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকেও বিভিন্ন প্রজাতির আমের চারা সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। নিজের জমিদারিতে থাকা বিলাইমারি থেকে মানিকচকের মথুরাপুর পর্যন্ত ফুলহরের ধারে সেসব আমের চারা বসিয়ে বিশাল বাগান তৈরি করেছিলেন। সেই বাগানের আয়তন ছিল ১৯০০ বিঘা। এর সঙ্গে ৩০০ বিঘা জমিতে লিচুর বাগানও তৈরি করেন। স্থানীয় লোকজন এই ২২০০ বিঘার বাগানের নামকরণ করেছিল হরিবাগান। এখনও সেই নাম এলাকাবাসীর মুখে মুখে। তবে সেই বিশাল বাগানের আর কোনও অস্তিত্ব এখন নেই। সবই চলে গিয়েছে ফুলহরের গর্ভে৷
একসময় আম-লিচুর সেই বাগানে দুর্গাপুজোর পত্তন করেন হরিমোহনবাবু। সেই পুজো ঠিক কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা জানা নেই স্থানীয়দের। এনিয়ে তেমন কোনও তথ্য নেই তাঁর উত্তরসূরিদের কাছেও। তবে জানা যাচ্ছে, কোনও একসময় বিলাইমারি এলাকাতেই এই পুজো চালু করেছিলেন হরিমোহনবাবু। ফুলহরের ভাঙনে বার বার সেই পুজো স্থান পরিবর্তন করেছে। বিলাইমারি থেকে কমলপুর সূর্যাপুর, সেখান থেকে শিবপুর ঘাটে গিয়ে ঠেকেছে এই পুজো। পরবর্তীতে মিশ্র জমিদারির এক কর্মী হরেশ্বর সিংহ এই পুজো নিয়ন্ত্রণ করতেন। পুজোর খরচ জমিদারি এস্টেট থেকে দেওয়া হত। তবে সেসব এখন অতীত। এখন শিবপুর ঘাটেই মায়ের পুজো হয়। সেখানে তৈরি হয়েছে দুর্গামন্দির। এখন আর হরিমোহন মিশ্রের পরিবার নয়, এলাকার মানুষজনই এই পুজো করে থাকেন। এলাকাবাসীর মুখে এই পুজো এখন বুড়ি মায়ের পুজো।
সেই বুড়ি মায়ের পুজো নিয়েই বলছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা রাজেশ সিংহ। তাঁর কথায়, ‘এই পুজোর বয়স কত, তা আমরা কেন, আমাদের পূর্বপুরুষরাও বলতে পারছেন না। তবে যা অনুমান করা হচ্ছে প্রায় ৩৫০ বছরেরও বেশি দিন ধরে পুজো হয়ে চলে আসছে। আমরা পূর্বপুরুষদের মুখে শুনেছি, হরিশ্চন্দ্রপুরের জমিদার হরিবাবু, যাঁর উত্তর পুরুষ সৌরেন্দ্রমোহন মিশ্র বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন৷ তিনিই এই পুজোর পত্তন করেন। ২২০০ বিঘার হরিবাগানেই এই পুজো শুরু হয়। কিন্তু ফুলহরের ভাঙনে কাটতে কাটতে এই পুজো শিবপুর মৌজায় স্থাপিত হয়। এখানে ১২৮২ বঙ্গাব্দ থেকে এই পুজো হয়ে আসছে।
নদী ভাঙনের জন্য আগে মায়ের অস্থায়ী মন্দির তৈরি করা হয়েছিল। দেড় দশক আগে কংক্রিটের মন্দির তৈরি হয়েছে। এখন শিবপুর দুর্গাপুজো কমিটি এই পুজো করে। পুজো কমিটিতে বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ রয়েছেন। বিভিন্ন গ্রামে ভিক্ষা করে এখন বুড়িমা’র পুজো হয়। করোনাকালে মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া ৫০ হাজার টাকা পেয়ে আমরা উপকৃত হচ্ছি। এখানে খিচুড়ি ভোগ হত, দুঃস্থদের বস্ত্রদান করতাম। কিন্তু করোনার জন্য সরকারি নির্দেশ মেনে এসব কাটছাঁট করতে হয়েছে। এই পুজোয় ছাগবলি প্রথা রয়েছে। নবমীতে প্রায় আড়াইশো ছাগবলি হয়।’
বুড়িমা’র মন্দিরের সেবাইত অসিতকুমার সিংহ জানাচ্ছেন, ‘ফুলহরের ভাঙনে এই পুজো বার বার সরে এসেছে। শিবপুর মৌজাতেও পুজোর স্থান পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে অবশ্য এক জায়গাতেই এই পুজো হচ্ছে। এখন আমরাই পুজো করে থাকি। এই পুজোতে জাঁকজমক খুব একটা নেই। তবে পুরোনো রীতি মেনে পুজো পদ্ধতিতে কোনও পরিবর্তন নেই। এবার পুজোর বাজেট প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা।’