তালিবানি অত্যাচা, ১০ বছর পুরুষ সেজে ছিলেন এই আফগান মহিলা

তালিবানি অত্যাচা, ১০ বছর পুরুষ সেজে ছিলেন এই আফগান মহিলা

 

কাবুল: দু-দশক পর আফগানিস্তানের দখল নিয়েছে তালিবান। দেশ জুড়ে হিংসা, খুন-সন্ত্রাসের ছবি স্পষ্ট। কোথাও বিউটি পার্লারের বাইরে মহিলাদের ছবি মোছার চেষ্টা! কোথাও বা সংবাদমাধ্যম থেকে মহিলা অ্যাঙ্করকে বের করে দেওয়ার ঘটনা হচ্ছে! আফগানিস্তানের বল্খ প্রদেশের যে গভর্নর সালিমা মাজারি তালিবান রুখতে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন তাঁকেও আটক করেছে জঙ্গিরা।

তালিবানের কব্জায় চলে যাওয়ার পর, এটাই এখন আফগানিস্তানের বাস্তব পরিস্থিতি! ক্ষমতা দখলের পর মুখে ভাল ভাল কথা বললেও, গত কয়েকদিনেই সামনে চলে এসেছে তালিবানের নারী-বিদ্বেষের পুরনো ছবি। যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন এই বাংলার এক মেয়ে। এক কাবুলিওয়ালাকে বিয়ে করার পর আফগানিস্তানে গিয়ে কীভাবে বদলে গিয়েছিল তাঁর জীবন? সেই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালী বৌ’ বইয়ে লিখেছিলেন সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তালিবান সমাজের বিরুদ্ধে কলম ধরায় প্রগতিশীল সুস্মিতার কপালে জুটেছিল মৃত্যুদণ্ড।

তালিবান শাসনের এই আক্রোশ থেকে রক্ষা পেতে নিজের পরিচয় লুকিয়ে আফগানিস্তানে বড় হয়েছেন নাদিয়া গুলাম দাস্তগির। শারীরিক এবং মানসিকভাবে মহিলা হওয়া সত্ত্বেও জন্মভুমিতে পুরুষ হিসেবে জীবন কাটান নাদিয়া। তালিবানের হাত থেকে রক্ষা পেতে এছাড়া আর কোনও উপায়ই ছিল না তাঁর সামনে। অন্য দেশে পালানোর পরই নিজের আসল পরিচয় সামনে আনেন নাদিয়া, তখন তিনি যুবতী। জীবনের সেই ১০ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে নাদিয়া জানিয়েছেন-  ১৯৮৫ সালে কাবুলে জন্ম হয় নাদিয়ার। সেই সময় গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি আফগানিস্তানে। মহিলাদের বিন্দুমাত্র অধিকার ছিল না। বোরখা এবং হিজাব ছাড়াও আরও নানা বিধিনিষেধ চাপানো ছিল তাঁদের উপর। মেয়ে হিসেবে জণ্ম, কিন্তু তাঁর দেশে যে মেয়েদের বাঁচার অধিকারটুকুই নেই। চোখের সামনে যখন তখন মেয়েদের তুলে নিয়ে যেত তালিবানরা। খুন, অঙ্গচ্ছেদ— সব কিছুই ছিল সাধারণ ঘটনা। সেই দেশে বাঁচার জন্য ছদ্মবেশ নিতে হয় নাদিয়াকে। একটা সময়ে ভয়াবহ তালিবান হামলায় পড়তে হয় তাঁদের পরিবারকে।

১৯৯৩ সালে তালিবানের ছোঁড়া বোমা এসে পড়েছিল তাঁদের বাড়িতে। বাড়ির একাংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পরিবারের অনেক সদস্যই ওই হামলায় মারা যান। যার মধ্যে নাদিয়ার ভাইও ছিল। গুরুতর জখম হয়েছিলেন নাদিয়া নিজেও। পরের দু’বছর হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। এরপরই ১৯৯৬ সালে, কাবুল পুরোপুরি তালিবানদের দখলে চলে যায়। ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে মায়ের কথা মতো পুরুষের বেশ ধরেন নাদিয়া। মৃত ভাইয়ের পরিচয়ে নতুন জীবন শুরু করেন। পুরুষের বেশে একা বাড়ির বাইরে বের হতেন। মসজিদে গিয়ে কোরান পড়তেন। পরে কাবুলের এক মসজিদে কর্মচারী হিসাবে কাজে যোগ দেন। ‘পুরুষ’ হওয়ার জন্য ১৬ বছর বয়সে স্কুলেও ভর্তি হতে পেরেছিলেন। পুরুষ সেজে দিনের পর দিন উপার্জন করে বাড়ি ফিরতেন। সেই টাকাতেই চলত সংসার।

কিন্তু আর সম্ভব হচ্ছিল না। বয়সের সাথে সাথে পোশাক ছাপিয়ে নারীসত্ত্বা জানান দিতে শুরু করছিল। কাজের সুবাদে, ২০০৬ সালে আফগানিস্তানের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি সংস্থার সাহায্যে কাবুল থেকে স্পেনে আশ্রয় নেন নাদিয়া। স্পেন থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ২০১৬ সালে ‘ব্রিজেস অব পিস’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থাও গড়ে তুলেছেন এই আফগান মহিলা। স্পেনের ওই শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া তাঁর মতো আরও অনেকের শিক্ষার দায়িত্ব এখন নাদিয়ার কাঁধে। দেশ ছাড়ার সঙ্গে পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে তাঁর। তালিবান প্রত্যাবর্তনের পর দেশের পরিস্থিতি দেখে পরিবারকে খুঁজে পাওয়ার আর কোনও সম্ভাবনাও দেখছেন না তিনি। তালিবানের চোখে ধুলো দিয়ে নাদিয়া দেশ ছাড়তে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু আরও অনেক ‘নাদিয়া’ এখনও রয়ে গিয়েছে আফগানিস্তানে। প্রতিটা মুহূর্ত মৃত্যুভয়ের মধ্যে দিয়ে কাটাচ্ছেন তাঁরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 4 =