শেষবারের মতো মৃত সন্তানকে দেখে জঙ্গলে ফিরল মা হাতি

শেষবারের মতো মৃত সন্তানকে দেখে জঙ্গলে ফিরল মা হাতি

জলপাইগুড়ি: শেষবারের মতো দেখে পিছন ঘুরল মা। মৃত সন্তানকে গত তিনদিন ধরে আগলে রেখেছিল সে। কিন্তু আর নয়। দলের অন্যরা চলে গিয়েছে আগেই। এবার সে নিজেও ফিরে গেল দলের অন্য সদস্যদের কাছে। গত তিনদিন ধরে মৃত সন্তান নিয়ে এক মা হাতির শোক পালন দেখেছিল রেড ব্যাঙ্ক চা বাগান। সদ্যোজাত সন্তান আর ফিরবে না। একথা বুঝতে পেরেই সম্ভবত মা তাকে রেখে গেল। বনকর্মীদের মধ্যেও হতাশা। কর্মজীবনে আগে কেউ এমন ঘটনা দেখেননি। পরবর্তী সময়েও এমন ঘটনা দেখা যাবে কিনা, সেটি লাখ টাকার প্রশ্ন।

তিন দিন আগেই সদ্যোজাত শাবক মারা গিয়েছিল। ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। দেহে পচন ধরা স্বাভাবিক। তবুও মা হাতি মৃতদেহ আঁকড়ে দাঁড়িয়েছিল চা বাগানের ভিতর। দলের বাকি সদস্যরা চলে যেতে শুরু করে রবিবার সন্ধ্যার পর থেকেই। মা হাতির সঙ্গে আরও দুটি হাতি উপস্থিত ছিল চা বাগানে। তারাও একসময় ফেরার পথ ধরে। বনকর্মীরা তখনও অপেক্ষা করছেন। কি করবে মা হাতি?

 সোমবার সকালের পর দেখা যায় মৃতদেহ ছেড়ে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছে সে। এরপর দলের সদস্যরা যে পথে গিয়েছে সেদিকেই পা বাড়ায়। বনকর্মীরা তাও নির্দিষ্ট দূরত্বে অপেক্ষা করে বেশ কিছুক্ষণ। আবার মা হাতি হয়তো ফিরে আসতে পারে। কিন্তু সে আর ফেরেনি। সন্তান তার কাছে আর ফিরে আসবে না। এই বার্তা সম্ভবত সে বুঝতে পেরেছে। তিন দিন ধরে সদ্যোজাতকে ফিরিয়ে আনার জন্য একাগ্র চিত্তে দাঁড়িয়েছিল সে।

 হাতিদের মনস্তাত্বিক চরিত্রে এই ঘটনা বেনজির। পরিস্থিতি রীতিমতো গুরুগম্ভীর চা বাগান এলাকায়। সোমবার বেলার দিকে বনকর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছন। খানিক দূর যাওয়ার পরেই পাওয়া যায় পচা গন্ধ। মৃতদেহে পচন শুরু হয়ে গিয়েছে। দেহটি ময়নাতদন্ত করতে হবে। সে কারণে মৃতদেহটি উদ্ধার করা হয় চা বাগানের ভেতর থেকে। কি কারণে শাবকটি মারা গেল? তা জানা অত্যন্ত প্রয়োজন বনকর্মীদের কাছে। রেডব্যাঙ্ক চা বাগান আবার পুরনো ছন্দে ফিরে আসবে। কাজ শুরু হবে বাগানের। তার মধ্যেই থেকে যাবে এক মা ও সদ্যোজাত সম্পর্কের করুণ কাহিনী।

গত ২৭ তারিখ শুক্রবার মৃত শাবককে নিয়ে ঘুরতে দেখতে পাওয়া যায় মা হাতিটিকে। শাবক মারা গেলে হাতির দল তাকে রেখে অন্যত্র যাত্রা করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। মা হাতি আঁকড়ে থেকেছে শাবকটিকে। অন্যান্য হাতিও তাকে সঙ্গ দিয়েছে। এই ঘটনা অনভিপ্রেত। এক ঘন্টা, দু’ঘন্টা নয়, টানা তিন দিন মা হাতি তার সন্তানকে আগলে রেখেছে শরীরের কাছে। শুঁড় দিয়ে তাকে ওঠানোর চেষ্টা করেছে। একবার মাটি খুঁড়ে কবর পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছিল তারা। পরক্ষণেই হয়তো কিছু ভাবনা আসে। মাটি খুঁড়ে ফের  মৃত শরীরকে বের করে নেয় মা। সারাদিন শাবকটিকে  সঙ্গে নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে চা বাগানের ভেতর।

মৃত শাবককে শুঁড়ে নিয়ে সাত কিলোমিটারের বেশি রাস্তা মা হাতিটি ঘুরে বেরিয়েছে। হাতি বিশেষজ্ঞরাও হতবাক এই ঘটনায়। বনকর্মীরা জানাচ্ছেন, প্রকৃতির জীব বৈচিত্রে কত কিছু দেখতে পাওয়া যায়। তবে এমন বেদনাদায়ক ঘটনার সাক্ষী আর থাকতে চান না তারা। গরুমাড়ায় চা বাগানকে ঘিরে হাতির দল সহাবস্থান করে।

মানুষ – হাতি সম্পর্ক খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই আধুনিক পৃথিবীতে। হাতিরা আক্রান্ত হচ্ছে মানুষদের দ্বারা। উল্টোদিকে হাতিরাও মানুষের প্রাণ নিচ্ছে। এই অবস্থায় আধুনিকতম পৃথিবী এক সদ্যোজাত শিশুর মৃত্যু ঘিরে মা হাতির করুণ কাহিনী দেখল। চা বাগানের সবুজে রয়ে গেল নিঃশব্দ কান্নার স্রোত।