৭০ বছরের জামাইকে ষষ্ঠী, শাশুড়ির বয়স ৪০ বছর! বৃদ্ধাশ্রমের এক প্রেম-পরিনতির মধুর গল্প!

৭০ বছরের জামাইকে ষষ্ঠী, শাশুড়ির বয়স ৪০ বছর! বৃদ্ধাশ্রমের এক প্রেম-পরিনতির মধুর গল্প!

কৃষ্ণনগর:  জামাইয়ের বয়স ৭০। শাশুড়ির বয়স ৪০ বছর। জামাই- শাশুড়ির বয়সের পার্থক্য নিয়ে এই গল্প নয়। মাধুর্যতা নিয়ে গিয়েছে সম্পর্ককে বহুমূল্যে। বৃদ্ধাশ্রমের দুই বৃদ্ধ- বৃদ্ধার চার হাত এক হয়েছিল সম্প্রতি। তাদেরই এবার জামাই ষষ্ঠীর ভোজ দেওয়া হল। প্রথমবার জামাই ষষ্ঠীর আমন্ত্রণ পেয়ে খুশি সুব্রত সেনগুপ্ত। শুধু জামাই নয়, কনে অপর্না চক্রবর্তীকেও সমান আপ্যায়ন করা হয়েছে। এই গোটা বিষয়ের কাণ্ডারি বছর ৪০ এর গৃহবধূ পাপিয়া কর।

 

রানাঘাটের পূর্বনগর গ্রামের একটি বৃদ্ধাশ্রমে সুব্রত ও অপর্ণার আলাপ। সুব্রত অপর্ণাকে পছন্দ করতে শুরু করেন। বেশ কিছু ঝড়ঝাপটা আসে তাদের আলাপ পরিচয়ের সময়। পরবর্তীতে তারা দাম্পত্যে আসেন। এবার তাদের প্রথম জামাইষষ্ঠী। কিন্তু তাদের ষষ্ঠীর ভোজ খাওয়াবেন কে? তাই নিয়ে চর্চা চলছিল বৃদ্ধাশ্রমে। কৃষ্ণগঞ্জ থানার মাজদিয়া গ্রামের পাপিয়া এগিয়ে এসেছেন উদ্যোক্তা হিসেবে। পাপিয়া নিজেই সমস্ত কিছুর আয়োজন করেন। নতুন জামাই- মেয়েকে রীতিমতো আদর আপ্যায়ন করে খাওয়ানো হয়। পাখার বাতাসে দীর্ঘায়ু কামনা করা হয়। মঙ্গল কামনার জন্যই তো জামাইষষ্ঠী।

 

রাণাঘাটের ওই বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা ছিলেন সুব্রত। সেখানেই থাকতেন অপর্ণা। আলাপপর্ব ঘনীভূত হতে শুরু করে। সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার প্রস্তাব গিয়েছিল অপর্ণার কাছে। অপর্ণা সেই প্রস্তাব খুশিমনে গ্রহণ করেনি। বিরহ বুকে বৃদ্ধাশ্রম ছেড়েছিলেন সুব্রত। উল্টো দিকের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতে শুরু করেন তিনি। কিছু দিন পরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সুব্রত। তাকে দেখাশোনার মতো কেউ নেই। সেইসময় অপর্ণা গিয়ে তার সেবা-শুশ্রূষা করেন। সুস্থ হয়ে ওঠেন রোগী। মনের কাছাকাছি আসা তখন থেকেই। এরপর বৃদ্ধাশ্রমের পক্ষ থেকে তাদের দুজনের বিবাহের ব্যবস্থা করা হয়। বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দারা তাদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। এই বছর তাদের প্রথম জামাইষষ্ঠী। সুব্রত বলেছিলেন, ভাইদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু সেখানে থাকার জায়গা নেই। অপর্ণার বাড়িতেও মা-বাবা নেই। কাজেই জামাইষষ্ঠী করার জায়গা ছিল না। পাপিয়া জামাইষষ্ঠীর জন্য নিমন্ত্রণ করেন। এক বাক্যে তিনি রাজি হয়ে যান।

 

পাপিয়া বরাবর সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে আবদ্ধ থাকেন। ফেসবুকেও তার যথেষ্ট পরিচিতি রয়েছে। এই কারণে দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার প্রথমবার জামাইষষ্ঠীর দায়িত্ব নেন পাপিয়া। বুড়ো বয়সে বিয়ে হয়েছে তো কি? জামাইষষ্ঠী কি করা যাবে না? একবাক্যে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন সুব্রতবাবু। কৃষ্ণনগর পুরসভার সুখনীড় ভবনে মেয়ে জামাই আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়। রোববার বিকেলে অনুষ্ঠান ছিল জমজমাট। মেয়ে জামাইকে সাধ্যমতো পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে দিয়েছিলেন পাপিয়া নিজে। জামাই ও মেয়েকে নকশা আঁকা মাটির থালা গ্লাস ঘটিবাটিতে খাবার দেওয়া হয়। মেনুতে ছিল সাদা ভাত, ডাল, আলু ভাজা, বেগুন ভাজা, পটোল ভাজা, পটোল চিংড়ি, কাতলা মাছের মুড়ো, কাতলা মাছের কালিয়া, মুরগির মাংস। শেষপাতে চাটনি, দই আর মিষ্টি।

 

জামাইকে নতুন পাখার বাতাস হয়। সেই পাখাও অত্যন্ত বাহারি। জামাইকে প্রথমে খেতে দেওয়া হয়েছিল দই, চিড়ে, আম, জাম, কলা, লিচু, খেজুর। শুধু জামাই নন মেয়েকেও একইভাবে আপ্যায়ন করা হয়। জামাই ও মেয়েকে পাশাপাশি বসিয়ে খাওয়ানো হয়। তখন পাখার বাতাস করেছেন পাপিয়া। বৃদ্ধাশ্রমের অন্যান্যরাও উপস্থিত ছিলেন। বেজেছে শাঁখ, উলুধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছে তাদের মঙ্গল কামনায়।

এমন আপ্যায়ন পেয়ে খুশি অপর্ণাও। তার নিজেরও কাছের বলতে কেউ নেই। মা বাবা চলে গিয়েছেন অনেক আগেই। অনেক বছর ধরেই তিনি বৃদ্ধাশ্রমের রয়েছেন। লাল শাড়িতে অপর্ণা হয়ে উঠেছেন আরও স্নিগ্ধ। পাকা চুলে মাঝখানের সিঁথিতে তখন গভীর লাল সিঁদুর। জুঁই ফুলের মালা খোঁপায়। আক্ষরিক অর্থেই সদ্য বিবাহিতা তরুণী যেন উপস্থিত হয়েছেন জামাইষষ্ঠীতে।

জামাইষষ্ঠীর খাওয়া হবে। কিন্তু উপহার দেওয়া হবে না? তাও কি হয়! জামাইকে শাশুড়ি দিয়েছেন কোঁচানো ধুতি ও পাঞ্জাবি। মেয়েকে দিয়েছেন লাল টুকটুকে জামদানি শাড়ি ও ইমিটেশনের গয়না। পাপিয়া নিজে সাজিয়েছিলেন তার বৃদ্ধা মেয়েকে। অভিনব এই জামাই ষষ্ঠী লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

14 + 6 =