বিরাট একখানা বিরিক্ষি বট গাছ। তার নিচে পলিথিন খাটিয়ে খুলেছেন হোটেল। ছোটখাটো চেহারার হোটেল মালকিন। পড়নে একখানা রংচটাশাড়ি। পাক ধরেছে মাথার চুলে। চোখে মুখে দারিদ্রতার ছাপ স্পষ্ট। এভাবেই হাসিমুখে ৫০ টা বছর ধরে চালিয়ে আসছেন ব্যবসা। এখানে মাত্র ৩০ টাকায় পাওয়া যায় ভরপেট খাবার। সঙ্গে মেলে আন্তরিকতার সঙ্গে পরিবেশন। কোথায় গেলে চেখে দেখার সুযোগ মিলবে ঠাকুমার হাতে রান্না স্বাদ? সেই ঠিকানায় দেবে আজকের এই প্রতিবেদন।
গড়িয়াহাট গেলেই পাবেন ঠাকুমার এই হোটেলের সন্ধান। গরিয়াহাট মোড় থেকে হিন্দুস্তান পার্ক যাওয়ার পথেই পড়বে হোটেলটি। না হটেলের সেভাবে কোন নাম নেই। তাই নাম জিজ্ঞেস করে আপনি এই হোটেলর হদিস পাবেন না। তবে ‘ঠাকুমার হোটেল’ নামে পরিচিত স্থানীয়দের কাছে এই হোটেল। পার পাঁচটা ঝাঁ চকচকে হোটেলের মত নয় ঠাকুমার হোটেলটি। একেবারে সাদামাটা। মাথার উপর নেই ফ্যান, তবে বট গাছের শীতল ছায়া রয়েছে। আর পাতা আছে দুটি কাঠের বেঞ্চ, সেখানে বসেই চেটেপুটে খাবারের স্বাদ আস্বাদন করেন গ্রাহকেরা।
এভাবেই দীর্ঘ ৫০ টা বছর এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধা। ছুটির বার বাদে প্রতিদিনই খোলা থাকে ‘ঠাকুমার হোটেল’। সকাল ১১ টা থেকে বিকেল চারটের মধ্যে পৌঁছতে পারলেই মিলবে ঠাকুমার হাতে রান্না করা খাবার। তারপর অবশ্য আর খাবার পাবেন না! কারণ এর মধ্যেই শেষ হয়ে যায় ঠাকুরমার হাতে তৈরি সমস্ত পদ। তাই বাসি খাবার এই হোটেলে আশাই করা যায় না।
তাই নিয়মিত এই হোটেলে গ্রাহক সংখ্যা নেহাত কম নয়। অফিস যাত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন মানুষজন চলে আসেন ঠাকুরমার কাছে। খেয়ে যান পেট পুরে। খাবারের স্বাদও নাকি একেবারে বাড়ির মত। এমনটাই জানাচ্ছেন নিয়মিত খেতে আসা গ্রাহকেরা। গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি আরও একটা কারণ আছে। তাহল খাবারের দাম। ঠাকুমার হোটেলে খাবারের দাম অনেকটাই কম। হ্যাঁ, মাত্র ৩০ টাকাতেই আপনি পেটপুরে খেতে পারবেন সবজি ভাত। আর ১০ টাকা বেশি দিলেই সঙ্গে পাবেন একটা ডিম। ৫০ টাকায় পাওয়া যায় মাছ। আর ৬০ টাকায় মেলে মাংস ভাত।
তাহলে মন্দ কোথায় বলুন? দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাজারে এতটা সস্তায় আর কোথায় পাবেন হাতে তৈরি টাটকা খাবার। ও হ্যাঁ বলতে ভুলে গেছি… ঠাকুমা কিন্তু নিজের হাতেই বাজার-হাট করা থেকে শুরু করে রান্নাবান্না, পরিবেশন, মাজা-ধোয়া সমস্তটাই একাই করেন। না কোন হেল্পিং হ্যান্ড নেই। তার কোন প্রয়োজনও পড়ে না বলেই জানিয়েছেন বৃদ্ধা। ভোর পাঁচটাতেই খুলে যায় হোটেলের দরজা থুরি পলিথিন। তবে সে সময় গেলে খাবার মিলবে না। ঠাকুমা তখন থাকেন খাবার জোগানের ব্যবস্থায়। নিজের হাতে সবজি কুটে উনুন জ্বালিয়ে চাপান ভাতের হাড়ি। না, গ্যাসের কোন ব্যবস্থা নেই এখানে। উনুনেই রান্না হয় প্রত্যেকটা পদ। প্রত্যেকদিন প্রায় ৫০ জনের মতো রান্না করেন বৃদ্ধা।
৭০ এর কাছাকাছি বয়স বৃদ্ধার। এখনও নিজের হাতেই সামলে যাচ্ছেন সবটা। আর এই হোটেলের উপার্জনের অর্থ দিয়েই চলে আট জনের সংসার। পরিবারের বাকি সদস্যদের সেভাবে কোন ইনকাম নেই। তাতে অবশ্য কোন আক্ষেপ নেই বৃদ্ধার। নিজের পরিশ্রমের অর্থ দিয়ে চলে যাচ্ছে কোন মতে সংসার। তবে আগে স্বামীকে পাশে পেতেন। দুজনে মিলে চালাতেন হোটেল। কিন্তু মাস কয়েক আগে স্বামী মারা জাওয়াই একা হয়ে পড়েন বৃদ্ধা। তখন থেকেই একা হাতে সামলে যাচ্ছেন হোটেল। উপায় কি পরিবারের সদস্যদের মুখে অন্ন তুলে দিতে এছাড়া যে আর কোন পথ নেই। তাই দারিদ্রতা ভুলে একমুখ হাসি নিয়ে রোজ কাঁপা হাতেই গ্রাহকদের মুখে তুলে দিচ্ছেন দুমুঠো অন্ন।