কলকাতা: পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে রাজ্যের প্রত্যেকটি জেলায় খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছে বিরোধীরা। তৃণমূল ঝড়ের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন জেলার কয়েকটি অঞ্চলে বিরোধীদের ফল মোটের উপর সন্তোষজনক হলেও সার্বিক ভাবে তা বলার মতো কিছু নয়। বিজেপি যতটা তেড়েফুঁড়ে নেমেছিল, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ধারাবাহিকভাবে কর্মীদের যেভাবে চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছেন, তা কিন্তু সেভাবে কাজে লাগেনি। তবে ব্যতিক্রম পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম। নন্দীগ্রামের ১৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ১০টি দখল করে বিজেপি ফের তৃণমূলকে জবাব দিতে পেরেছে। এর পুরো কৃতিত্বই যে শুভেন্দুর সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নন্দীগ্রামের পাশাপাশি পূর্ব মেদিনীপুরেও বিজেপির ফল গতবারের থেকে অনেকটাই ভাল হয়েছে।
গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় মাত্র একটি পঞ্চায়েত দখল করেছিল। সেটিও পরে তৃণমূলের দখলে চলে যায়। কিন্তু এবার শুভেন্দুর জেলায় বিজেপি আশিটি পঞ্চায়েত দখল করেছে। তবে রাজনৈতিক মহলের বিশেষ নজর ছিল নন্দীগ্রামের দিকেই। সেখানে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল ‘বদলা’ নিতে পারল না। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে হারের পর পঞ্চায়েত নির্বাচনেও নন্দীগ্রাম পুনরুদ্ধার করতে পারল না শাসক দল। নন্দীগ্রামের ১৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে দশটিতেই ফুটেছে পদ্মফুল।
অর্থাৎ নন্দীগ্রামে রং থাকল সেই গেরুয়াই। নন্দীগ্রামকে এবার পাখির চোখ করেছিল তৃণমূল। কলকাতা থেকে তৃণমূলের হেভিওয়েট নেতৃত্ব সেখানে বারবার প্রচার করতে গিয়েছেন। তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নবজোয়ার’ কর্মসূচি উপলক্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন নন্দীগ্রামে। করেছিলেন রোড শো। কিন্তু তাতেও শুভেন্দুর হাত থেকে নন্দীগ্রাম ছিনিয়ে নিতে পারেনি তৃণমূল। আর বিষয়টি নিয়ে শুভেন্দুর দাবি, শুধু নন্দীগ্রাম বলে নয়। অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে বাংলার প্রতিটি প্রান্তে একই ফলাফল হতো। তাঁর কথায়, পঞ্চায়েত নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন হয়নি। ব্যালটে কারচুপি ও বেলাগাম সন্ত্রাস করে তৃণমূল জিতেছে বলে দাবি করেছেন শুভেন্দু।
স্বাভাবিকভাবেই নন্দীগ্রামে অধিকাংশ পঞ্চায়েত হাতছাড়া হওয়ায় মুষড়ে পড়েছে তৃণমূল। গত পঞ্চায়েত ভোটে নন্দীগ্রামের প্রত্যেকটি পঞ্চায়েত ছিল তৃণমূলের দখলে। কিন্তু এবার ছবিটা বদলে গেল। তৃণমূল নেতৃত্ব ঠারেঠোরে স্বীকার করে নিচ্ছেন গতবার শুভেন্দু অধিকারী তাঁদের দলে ছিলেন বলেই নন্দীগ্রামে অত ভাল ফল হয়েছিল। শুভেন্দু অধিকারীর ভোটকেন্দ্র নন্দীগ্রামের নন্দনায়েক বাড়ের ৭৭ নম্বর বুথেও জিতেছেন বিজেপি প্রার্থী। স্বাভাবিকভাবেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে নন্দীগ্রামে নিজের গড় অটুট রেখে শেষহাসি হাসলেন বিরোধী দলনেতাই।
একুশের বিধানসভা নির্বাচনে ‘হটস্পট’ ছিল নন্দীগ্রাম। সেই নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ১৯৫৬ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দিয়েছিলেন শুভেন্দু। সেই হার যে তৃণমূল এখনও হজম করতে পারেনি তা স্পষ্ট। তাই তেইশের পঞ্চায়েত নির্বাচনে নন্দীগ্রামের ১৭টি গ্রাম পঞ্চায়েতেই জিততে আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে তৃণমূল। পাল্টা শুভেন্দু দাবি করেন তাঁর গড় অটুট থাকবে। বাস্তবে হয়েছেও তাই। বাংলায় পরিবর্তনের ‘ভরকেন্দ্র’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে নন্দীগ্রাম। আর জমি আন্দোলনের আঁতুরঘর সেই নন্দীগ্রামে পরপর দু’বার ধাক্কা খেল তৃণমূল। লোকসভা নির্বাচনের আগে বিষয়টি যে তৃণমূলকে কতটা অস্বস্তিতে ফেলল, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাই পঞ্চায়েতের ফলাফলে এটা স্পষ্ট নন্দীগ্রাম তথা পূর্ব মেদিনীপুর ছাড়া শুভেন্দু অধিকারীর প্রচার বা ‘ভোকাল টনিক’ রাজ্যের অন্যত্র কাজ করেনি। তবে বিজেপির অন্যান্য নেতৃত্ব তাঁদের গড় ধরে রাখতে না পারলেও বিরোধী দলনেতা নন্দীগ্রাম ধরে রাখতে পারায় কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্বের কাছে শুভেন্দুর কদর যে আরও বাড়বে সেটা স্পষ্ট। আর এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিঃসন্দেহে এটাই শুভেন্দুর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।