নয়াদিল্লি: বিজ্ঞানীদের কঠোর পরিশ্রম আর ১৪০ কোটি ভারতীয়ের প্রার্থনায় স্বপ্ন পূরণের পথে ইসরোর চন্দ্রযান ৩৷ শুক্রবার পূর্ব নির্ধারিত সময় মেনেই দুপুর ২ টো বেজে ৩৫ মিনিটে পৃথিবীর মাটি ছেড়ে চাঁদের পথে পাড়ি দেয় ‘বাহুবলী’ রকেট৷ শ্রীহরিকোটার সতীশ ধওয়ান স্পেস সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে উড়ে যায় ‘চন্দ্রযান ৩’৷ চার বছর আগে একরাশ আশা জাগিয়েও শেষমেষ চাঁদে নামতে পারেনি চন্দ্রযান ২৷ এর ল্যান্ডার ‘বিক্রম’-এর সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল ইসরোর। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই চন্দ্রযান ৩ গড়ে তোলেন ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানীরা। নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর যে নিরলস প্রচেষ্টা ইসরোর বিজ্ঞানীরা শুরু করেছিলেন, তাঁর প্রথম সাফল্য এল শুক্রবার। তবে চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য এখনও প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে হবে৷ এখনও পাড়ি দিতে হবে আরও অনেকটা পথ।
চন্দ্রযান-৩ এর গন্তব্য চাঁদের দক্ষিণ মেরু৷ এই মেরুতেই প্রথমবার জলের খোঁজ পেয়েছিল ইসরোর পাঠানো চন্দ্রযান-১। দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছনোর পর যদি চন্দ্রযান-৩ থেকে ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ সফল ভাবে চাঁদের মাটি ছুঁতে পারে এবং রোভার প্রজ্ঞানকে সঠিক ভাবে অবতরণ করাতে পারে, তাহলেই রচিত হবে ভারতীয় মহাকাশ অভিযানের নতুন ইতিহাস৷ ২০১৯ সালে ল্যান্ডার ‘বিক্রম’-কে চাঁদের পিঠে নামাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল চন্দ্রযান-২। যদিও সেই অভিযানে পাঠানো অরবিটরটি এখনও চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। তৃতীয় চন্দ্রযান সফল হলে আমেরিকা, চিন এবং রাশিয়ার পর ভারতই হবে চতুর্থ দেশ, যারা চাঁদের মাটি ছোঁবে৷ চিনের পর গত এক দশকে কোনও দেশের মহাকাশযান সফল ভাবে চাঁদে অবতরণের নজির গড়বে। আঁধার ঘেরা চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করবে ‘চন্দ্রযান ৩।’
২০১৯ সালের ২২ জুলাই শ্রীহরিকোটা থেকেই ‘জিএসএলভি মার্ক থ্রি’ রকেটে চেপে রওনা দিয়েছিল চন্দ্রযান-২৷ সেই উৎক্ষেপণও সফল হয়েছিল। এর তিনটি অংশ ছিল— অরবিটার, ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ এবং রোভার ‘প্রজ্ঞান’। ৬ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে প্রজ্ঞানকে পেটের ভিতরে ঢুকিয়ে সফট ল্যান্ডিং করার কথা ছিল বিক্রমের। সফল ভাবে অবতরণের পরে বিক্রমের শরীর থেকে বেরিয়ে আসত প্রজ্ঞান। কিন্তু, চাঁদের মাটি ছোঁয়ার মাত্র তিন মিনিট আগে বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায় ইসরোর। মহাকাশ বিজ্ঞানী ও ‘স্পেস ইঞ্জিনিয়ার’দের অধিকাংশেরই অনুমান , অবতরণের সময় গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না-পেরেই চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়েছিল বিক্রম।
সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই এ বার অনেক বেশি সতর্ক ছিলেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। উৎক্ষেপণ পর্ব নির্বিঘ্নে কেটেছে। এ বার নিরাপদে অবতরণের পালা৷ ২০১৯ সালের ৭ জুলাই চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে ‘সিমপেলিয়াস এন’ এবং ‘ম্যানজিনাস সি’ নামে দু’টি গহ্বরের মাঝখানে দ্বিতীয় চন্দ্রযানের ল্যান্ডার বিক্রম অবতরণের চেষ্টা করেছিল৷ কিন্তু চাঁদের খুব কাছে পৌঁছেও তা সম্ভব হয়নি। রোভার প্রজ্ঞানকে পেটের মধ্যে নিয়েই নিখোঁজ হয়ে যায় বিক্রম। এর পর প্রায় তিন মাস ধরে বিক্রমের ধ্বংসাবশেষের খোঁজ চালায় আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও বিক্রমকে খুঁজে পাননি তারা। শেষমেশ ‘লুনার রিকনাইস্যান্স অরবিটার’ (এলআরও)-এর তোলা একটি ছবি শেয়ার করে নাসা। সেই ছবি দেখে চেন্নাইয়ের এক মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বিক্রমের ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করেন। তাঁর দাবিকে স্বীকৃতি দেয় নাসা। সেদিন ল্যান্ডার এবং রোভার ধ্বংস হয়ে গেলও এখনও সক্রিয় ইসরোর অরবিটার৷ যা চাঁদের কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করছে। সেই অরবিটারকেই কাজে লাগাবে চন্দ্রযান-৩৷
ইসরো জানিয়েছে, প্রায় ৪০ দিন পর, আগামী ২৩ বা ২৪ অগাস্টের মধ্যে চাঁদের মাটিতে পৌঁছে যাবে ভারতের তৃতীয় চন্দ্রযান৷ সেখান পৌঁছে চাঁদের মাটির চরিত্র, বিভিন্ন খনিজ পদার্থের উপস্থিতি সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করবে রোভার প্রজ্ঞান। সূর্যোদয়ের মুহূর্তে চাঁদের মাটি অবতরণ করবে বিক্রম। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সূর্যাস্ত যাওয়ায় দু’সপ্তাহ পরে শেষ হবে তার কাজ।
এবার চাঁদে অবতরণের জন্য যে জায়গা বেছে নেওয়া হয়েছে, তার পরিধি গতবারের তুলনায় অনেকটা বেশি৷ গতবার চাঁদে অবতরণের জন্য ল্যান্ডার ‘বিক্রম’-র কাছে মাত্র ৫০০ মিটার জায়গা ছিল। এবার সেটা বাড়িয়ে ৪ কিলোমিটার করা হয়েছে। চাঁদে অবতরণের জন্য ল্যান্ডারের ‘পা’ আরও মজবুত করা হয়েছে। যাতে অবতরণের সময় দ্বিতীয় চন্দ্রযানের চেয়েও আরও বেশি বেগ সইতে পারে। ইসরোর অপর এক বিজ্ঞানী জানান, প্রতি সেকেন্ডে দু’মিটার বেগে ল্যান্ডারের অবতরণ করার বিষয়টি সুরক্ষিত বলা যেতে পারে। তার পরেও পরিস্থিতি যদি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে গতিবেগ বাড়িয়ে ল্যান্ডার অবতরণ করানো যেতেই পারে।