কলকাতা: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলের উপর থেকে পড়ে গিয়ে রহস্য-মৃত্যু হয়েছে নদিয়ার বগুলার বাসিন্দা স্বপ্নদীপ কুণ্ডুর। তিনি বাংলা স্নাতকের প্রথম বর্ষের পড়ুয়া ছিলেন। মৃত ছাত্রের সহপাঠীদের পাশাপাশি বাড়ির লোকজনের অভিযোগ র্যাগিংয়ের বলি হয়েছেন তিনি। এ কোথায় বাস করছি আমরা! বাড়ির ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে প্রাণ হারাবেন? পঠনপাঠন শেষে সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে আসার বদলে ছেলের মৃতদেহ বাড়িতে ঢুকবে?
ওয়াকিবহাল মহল মনে করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের একাংশের বোহেমিয়ান জীবনযাপন এই সমস্ত অনিয়মের অন্যতম প্রধান কারণ। মাত্রাতিরিক্ত স্বাধীনতা, যা কিছু করার মানসিকতা, সর্বক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতাই আজ শান্তিপ্রিয় পড়ুয়াদের কাছে অশান্তির কারণ হয়ে উঠেছে। যে কোনও বিষয় মন-পছন্দ না হলেই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামতে দেখা গিয়েছে যাদবপুরের ছাত্র-ছাত্রীদের। প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে প্রতিবাদী ভূমিকা থাকা দরকার। সেটা না থাকলে তাঁকে মানুষ বলা যায় না। সেই অর্থে যাদবপুরের পড়ুয়ারা প্রতিবাদ আন্দোলনে নেমে কোনও ভুল করেন না। কিন্তু ঘটনা হল বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে কোথায় থামতে হয় সেটা তাঁদের অনেকেই বোধহয় জানেন না।
আন্দোলনের নামে এমন অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করেন শিক্ষাক্ষেত্রে, যেটা একেবারেই কাম্য নয়। পড়ুয়াদের দ্বারা হেনস্থার শিকার হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি প্রফেসররাও, এমন উদাহরণও আছে। শুধু তাই নয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের একাংশের বিরুদ্ধে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ বা জীবনযাপনের অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। তবে সবাই নয়, কিছু পড়ুয়ার আচরণের জন্য সার্বিকভাবে যাদবপুরের নাম খারাপ হয়েছে বা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছেন প্রথম বর্ষের এক ছাত্র, এমনই গুরুতর অভিযোগ উঠেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে।
যাদবপুরের এক প্রাক্তনীকে ইতিমধ্যেই আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে পুলিশ। যাদবপুরে কান পাতলেই শোনা যায় বহু প্রাক্তন ছাত্র অতিথি হিসেবে বর্তমান ছাত্রদের সঙ্গে রুম শেয়ার করে হস্টেলে থাকেন। বছরের পর বছর ধরে এমনটাই চলে আসছে। আর সেই প্রাক্তনীদের কথা না শুনলে নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের পরিণাম সংঘাতিক হয়, এমনটাই অভিযোগ বহুদিন ধরেই রয়েছে সেখানে। তাই প্রশ্ন, কর্তৃপক্ষ সব জেনে বুঝেও কি নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকবে? যাদবপুরে বহুদিন আগেই গঠিত হয়েছে ‘অ্যান্টি র্যাগিং স্কোয়াড’। কিন্তু তাদের কোনও সক্রিয়তা দেখা যায় না বলেই অভিযোগ। তবে সবচেয়ে বড় কথা হল বিভিন্ন সময়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মদ, মাদক সেবনের পাশাপাশি বহিরাগতদের দাপাদাপির অভিযোগ উঠেছে। এগুলি বন্ধ করতে একটা সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিসিটিভি বসানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু পড়ুয়াদের একাংশের প্রবল বাধায় সেটা সম্ভব হয়নি।
কয়েক বছর আগের কথা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যে মাদক সেবনের অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে ধরে ফেলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। তাঁদের মধ্যে চারজন বহিরাগত ছিলেন। পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয় বহিরাগতদের। কিন্তু বহিরাগতদের সঙ্গে দু’জন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াও মাদক সেবন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন বেহুঁশ অবস্থায় ছিলেন। তবে মজার কথা হল তাঁদের দু’জনকেই ছেড়ে দেওয়া হয় কোনও ব্যবস্থা না নিয়েই। এই সমস্ত বিশৃঙ্খলার অভিযোগ বহুদিন ধরেই রয়েছে। তা বন্ধ করতেই সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
প্রশ্ন উঠছে, কিসের ভয়ে ক্যামেরা বসানোর প্রতিবাদ করেছিলেন পড়ুয়াদের একাংশ? ক্যামেরায় কি ধরা পড়ে যেত? এই সমস্ত প্রশ্ন নতুন করে উঠতে শুরু করেছে ছাত্র মৃত্যুর পরেই। তাই এটা স্পষ্ট দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবাধ স্বাধীনতা এবং পড়ুয়াদের একাংশের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন এমন বিপদ ডেকে আনছে। এর মোকাবিলা করা আদৌ সম্ভব কিনা সেটাই আজ চর্চার প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।