Aajbikel

কলকাতার ট্রাফিক সামলে ‘শবর পিতা’ খোয়ালেন ১০ মাসের বেতন

কলকাতা: ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ এমনই এক ছেলের ছেলেবেলার স্বপ্নের বীজ আজ মহীরুহ৷ পুরুলিয়ার পুঞ্চা গ্রামে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি বেড়ে উঠছিল ছোট্ট অরূপের স্বপ্ন৷ গ্রামের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা আদিবাসী সম্প্রদায় শবরদের জন্য কিছু করার স্বপ্ন৷ আর তার এই স্বপ্নপূরণের বীজমন্ত্র সেই ছেলেবেলাতেই মনে গেঁথে দিয়েছিল তার
 | 
কলকাতার ট্রাফিক সামলে ‘শবর পিতা’ খোয়ালেন ১০ মাসের বেতন

কলকাতা: ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ এমনই এক ছেলের ছেলেবেলার স্বপ্নের বীজ আজ মহীরুহ৷ পুরুলিয়ার পুঞ্চা গ্রামে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি বেড়ে উঠছিল ছোট্ট অরূপের স্বপ্ন৷ গ্রামের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা আদিবাসী সম্প্রদায় শবরদের জন্য কিছু করার স্বপ্ন৷ আর তার এই স্বপ্নপূরণের বীজমন্ত্র সেই ছেলেবেলাতেই মনে গেঁথে দিয়েছিল তার দাদু৷ মানুষের জন্য কিছু করতে হলে আগে নিজেকে মানুষ হতে হবে৷ জেদ চেপে বসে অরূপের মনে৷ আর সেই জেদের বলেই আজ তিনি কলকাতা সাউথ ট্রাফিক গার্ডের কনস্টেবল অরূপ মুখার্জি৷

কলকাতার ট্রাফিক সামলে ‘শবর পিতা’ খোয়ালেন ১০ মাসের বেতন

কলকাতা শহরে ব্যাস্ততম রাস্তায় ট্রাফিক সামলেও অবলীলায় সামলে চলেছেন সুদুর পুরুলিয়ার পুঞ্চা গ্রামে তার নিজের প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা ‘পুঞ্চা নবদিশা মডেল স্কুল’৷ দারিদ্র, অশিক্ষা, কুসংস্কারের অন্ধকারে শবর শিশুদের জন্য তৈরী এই স্কুল শুরু হয়েছিল মাত্র ১৫ জন পড়ুয়াকে নিয়ে এখন সংখ্যাটা ১২৫৷ শুধু পড়াশোনা নয় তাদের থাকা, খাওয়ায় ব্যবস্থাও করেন অরূপ বাবু৷ ‘নবদিশা’ স্কুলে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করানো হয়৷ আবার যারা পঞ্চম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে তাদেরও এই স্কুলে থাকা, খাওয়া, প্রাইভেট, প্যান্ট জামা সহ যাবতীয় জিনিস দেওয়া হয়৷ বাড়ির থেকে কোন জিনিস নেওয়া হয় না ৷ স্কুলে ৭ জন শিক্ষক, এক জন রাঁধুনি, একজন বাচ্চাদের দেখভাল করার জন্য এবং এক জন নাইট গার্ড আছেন ৷ এরা সকলেই বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে৷

কলকাতার ট্রাফিক সামলে ‘শবর পিতা’ খোয়ালেন ১০ মাসের বেতন

তবে তার এই কর্মকাণ্ডের শুরুর কথা অরূপ বাবু যা বললেন তা শুনলে অবাক হতেই হবে৷ একটু আক্ষেপের সুরেই অরূপ বাবু বললেন, ‘‘জানেন তো এই কাজ করতে যেয়ে আমার একটাও ইএল ছুটি নেই৷ বছরে ৩০ দিন এই ছুটি পাওয়া যায়৷ পরে অবসর গ্রহনের সময় সেই ৩০০ দিনের টাকা পাওয়া যায়৷ অর্থাৎ ১০ মাসের বেতন৷ সেই টাকা পাবোনা আমি৷” আমি কোনদিনও অফিসার পদের জন্য পরীক্ষায় বসবো না৷ অফিসার হলে চাপ বাড়বে, আমার শবরদের থেকে আমি দূরে হয়ে যাবো৷’’

কলকাতার ট্রাফিক সামলে ‘শবর পিতা’ খোয়ালেন ১০ মাসের বেতন

তিনি বলেন শবর সম্প্রদায়ের লোকেরা তার রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে, তাদের পাশেই থাকতে চান সব সময় একাই ঘুরে বেড়ান শবরদের গ্রামে গ্রামে৷ শবর সম্প্রদায়ের মানুষদের আগলে রাখেন, তারা যে বিপথে না চলে যায়৷ শবর সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েরা যাতে পড়াশোনা করে সরকারি চাকরি পায় তার জন্য সরকারের কাছে আবেদনও জানাচ্ছেন৷

কলকাতার ট্রাফিক সামলে ‘শবর পিতা’ খোয়ালেন ১০ মাসের বেতন

নিজের কর্মজীবন সম্পর্কে তার আগ্রহ শুধুমাত্র এই আদিবাসী মানুষগুলোর জন্য৷ অরূপ বাবুর স্মৃতিতে উঠে এলো সেই দিনগুলোর কথা- ‘‘১৯৯৯ সালে আমি কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল পদে যোগদান করি৷ প্রথম মাস থেকে আমি কিছু টাকা রাখতে শুরু করে দি৷ এবং ২০১০ সালে আমার ২৫০০০০/-টাকা জমা হয় এবং আমার এক বন্ধুর বাবার কাছে একটু জমি চাই৷ নাম ক্ষিরোদ শশী মুখোপাধ্যায় পুঞ্চা তে বাড়ি৷ আমার নামে ২২ ডেসিবেল জমি দান করে দেন৷ এবং আমার মায়ের শরীর অসুস্থ বলে ১৫০০০০/- টাকা লোন নি আর আমার মায়ের কাছে ৫০০০০/-টাকা নি৷ মোট ৪৫০০০০/- টাকা দিয়ে বাড়ি তৈরি করতে শুরু করি এবং ২০১১ সাল থেকে ১৫ জন শবর শিশু নিয়ে পুঞ্চা নবদিশা মডেল স্কুল এর পথ চলা শুরু হয়৷ এখন ১২৫ জন ছাত্র – ছাত্রী৷ নিজের মাইনের টাকার প্রায় সব চলে যায় স্কুলের বাচ্চাদের জন্য৷ এই জন্য কোন সরকারি সাহায্য আমি পাইনা৷ আর চাই না৷ আমার পাশে বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়েছেন বলে আমার বাচ্চাদের দুবেলা দুমুঠো মুখে অন্ন তুলে দিতে পারি৷ যদিও খুব কষ্টের মধ্যে আমি স্কুল চালাচ্ছি৷ আর শুধু স্কুল হলে ঠিক ছিল,কিন্তু এখন শুধু পুরুলিয়া জেলার শবর সম্প্রদায়ের না বাঁকুড়া জেলার শবর পরিবারের লোকজন যখন তখন চলে আসেন আমার কাছে ৷ যে কোন আপদে বিপদে বিভিন্ন গ্রামে আমাকে যেতে হয়৷ সময় মতো অনেক সময় পেটে খাবারও জোটে না ৷তাও তাদের বিশ্বাস আমি হারাতে চাই না৷’’

কলকাতার ট্রাফিক সামলে ‘শবর পিতা’ খোয়ালেন ১০ মাসের বেতন

তিনি আরও বলেন, ‘‘আমি কয়েক জন শবর মেয়েকে আর্থিক সাহায্য করি৷ তারা কলেজে পড়াশোনা করে৷ রমনীতা শবর ইতিহাস অনার্স এর তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী, শকুন্তলা শবর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী এবং বসুমতী শবর প্রথম বর্ষের ছাত্রী৷ সরকার যদি এদের চাকরি করে দেয় তাহলে শবর সম্প্রদায়ের মধ্যে পড়াশোনার চাহিদা বেড়ে যাবে এমন কি ২০০৭ সালে শবরদের মধ্যে প্রথম মাধ্যমিক পাশ করা শান্তি শবরের এখনও চাকরি হয় নি৷’’

কলকাতার ট্রাফিক সামলে ‘শবর পিতা’ খোয়ালেন ১০ মাসের বেতন

তবে এই কাজ করতে গিয়ে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাকে৷ যদিও তা তিনি গ্রাহ্য করেন না৷ তাদের ব্রাহ্মণ পরিবার হলেও সকলেই শবর সম্প্রদায়ের লোকজন কে অরূপ বাবুর পরিবারের লোক ভাবে৷এখনও শবর সম্প্রদায়ের ছোয়া জিনিস লোকে খায়না৷ অছ্যুত জাতি বলে৷ কিন্তু তাদের দেওয়া জিনিস মুখার্জি পরিবারের সকলেই খায়৷

কলকাতার ট্রাফিক সামলে ‘শবর পিতা’ খোয়ালেন ১০ মাসের বেতন

তাঁর কথায়, ‘‘একটা কথা আমি জেনেছি – ভগবান সকলের জন্ম দেয় কোন না কারণে, সবাই তা বুঝতে পারে না কিন্তু আমি বুঝতে পারছি যে আমার জন্মটা হয়তো শবর সম্প্রদায়ের জন্য হয়েছে৷ আর আমার ঠাকুমা বলেছিলেন যে গরিব মানুষ কে সাহায্য করলে ভগবান তোকে সাহায্য করবে৷ কারণ হলো ঠাকুমা প্রায় দিন ভোর বেলায় চাল চুরি করে পাশের বাড়িতে দিয়ে আসতো একদিন আমি পিছনে পিছনে গিয়ে চাল দিতে দেখি, তখন ঠাকুমা বলেছিলেন কাউকে বলিস না, এই চাল টা দিলাম বলেই ওরা সকালে ভাত খেতে পাবে৷ গরীব লোকদের সাহায্য করবি তো ভগবান তোকে সাহায্য করবে৷ এই সব কথা আমার কানে এখনও ভাসে৷’’ শবরদের নিয়ে কাজ করার জন্য এপর্যন্ত অনেক পুরস্কারও পেয়েছেন৷ তবে এখন তার কাজের পরিধি দিন দিন বেড়ে চলেছে৷ কতদিন একার চেষ্টায় এই কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন যা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন এই ‘ওয়ান ম্যান আর্মি৷’’

Around The Web

Trending News

You May like